ঢাকা ০৬:৫৭ পূর্বাহ্ন, সোমবার, ০১ ডিসেম্বর ২০২৫, ১৭ অগ্রহায়ণ ১৪৩২ বঙ্গাব্দ
ব্রেকিং নিউজ:
মাগুরা ২৫০ শয্যা বিশিষ্ট হাসপাতালে গোপন টেন্ডারে ৫০ লাখ টাকা আত্মসাৎ । পূর্ণ যৌবনা কুমার নদী এখন জৌলুস হারিয়ে মৃত প্রায় নদীতে রূপ নিয়েছে। মাদারীপুরে নবাগত পুলিশ সুপার ও সাংবাদিকদের সাথে মতবিনিময় সভা অনুষ্ঠিত। প্রকাশ্য দিবালোকে খুলনা আদালত চত্বরে গুলি করে দুইজনকে হত্যা। মাদারীপুরের রাজৈরে ১০ম গ্রেড বাস্তবায়নের দাবিতে মেডিকেল টেকনোলজিস্ট ও ফার্মাসিস্টদের কর্মবিরতি পালন। মাদারীপুরের রাজৈর উপজেলা বিএনপি ও অঙ্গ সংগঠনের উদ্যোগে তিনবারের প্রধানমন্ত্রী আপোষহীন নেত্রী বেগম খালেদা জিয়ার সুস্থতা কামনায় দোয়া ও মোনাজাত অনুষ্ঠিত। তিনবারের প্রধানমন্ত্রী গণতন্ত্রের মা দেশনেত্রী বেগম খালেদা জিয়ার সুস্থতা কামনায় বাংলাদেশ পূজা উদযাপন ফ্রন্ট কেন্দ্রীয় কমিটির উদ্যোগে প্রার্থনা সভা অনুষ্ঠিত। বাংলার কিংবদন্তি এক মহীয়সী নারী বেগম খালেদা জিয়া। টিকটকে প্রেম, ৬ বছরের শিশুকে রেখে পালালো মা। ভুয়া কাগজপত্র দেখিয়ে গাড়ীর ব্যবসায়ের নামে হাতিয়ে নিয়েছে কোটি কোটি টাকা বেইস- টেকের মালিক নীলয়।

শিক্ষিত তরুণরা কেন অন্ধকারের পথে ?

  • সারাক্ষণ ডেস্ক
  • আপডেট সময় : ০৮:৪৫:০৫ অপরাহ্ন, শনিবার, ৪ অক্টোবর ২০২৫
  • ১২১ জন সংবাদটি পড়েছেন

 

অপরাধ জগতের মানুষ বেশির ভাগ ক্ষেত্রে মরণনেশা বা মাদক কারবারে সম্পৃক্ত বলে শোনা যায়। এদের বেশির ভাগই শিক্ষার আলো থেকে বঞ্চিত। জন্ম-বেড়ে ওঠা হয়তো কোনো বস্তিতে বা মাদকের আখড়ায়। সেখান থেকে জড়িয়ে পড়ে মাদক চক্রে। দারিদ্র্য, শিক্ষার অভাব এবং প্রতিকূল পরিবেশ তাদের এই পথে ঠেলে দেয়। কিন্তু উদ্বেগের বিষয় হচ্ছে, বর্তমান সমাজের অনেক উচ্চবিত্ত পরিবারের সন্তান বা উচ্চশিক্ষিত তরুণরাও জড়িয়ে পড়ছেন ভয়ানক মাদকের কারবারে।

সংশ্লিষ্টরা বলছেন, চিহ্নিত অপরাধীদের পাশাপাশি বর্তমানে অনেক শিক্ষিত তরুণ-তরুণীও মাদক কারবারে জড়িয়ে পড়ছেন। প্রথমে বন্ধুদের সঙ্গে মাদক সেবন, এরপর চক্রের সদস্য হয়ে মাদক কারবারে জড়িয়ে পড়েন তারা। গত দুই বছরে মাদকদ্রব্য নিয়ন্ত্রণ অধিদপ্তরসহ আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর হাতে ধরা পড়েছেন এ রকম শতাধিক উচ্চশিক্ষিত তরুণ। কিন্তু এমন সম্ভাবনাময় উচ্চশিক্ষিত তরুণরা কেন মাদক কারবারের অন্ধকার পথে পা বাড়াচ্ছেন, সেটিও বড় প্রশ্ন হয়ে দেখা দিচ্ছে।

বিশেষজ্ঞরা বলছেন, ভৌগোলিক কারণে বাংলাদেশ এখন আন্তর্জাতিক মাদক পাচারকারীদের অন্যতম রুট ও বাজারে পরিণত হয়েছে। এখন তরুণরা কানাডা, ইংল্যান্ড, ইউরোপ ও আমেরিকা থেকে মাদক এনে দেশে বাজার তৈরির চেষ্টা করছেন। এ ছাড়া মেক্সিকো, নাইজেরিয়া, ক্যামেরুন, ভারত, মায়ানমারসহ আরও একাধিক দেশ হয়ে এ দেশে আসছে মাদক। তবে এটা নিয়ন্ত্রণ করা না গেলে দেশ ও ভবিষ্যতের সম্ভাবনাময় প্রজন্মের জন্য হুমকি হয়ে দেখা দেবে। এ জন্য পারিবারিক ও সামাজিকভাবে প্রতিরোধের পাশাপাশি আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর কঠোর অভিযান প্রয়োজন।

মাদকদ্রব্য নিয়ন্ত্রণ অধিদপ্তরের কর্মকর্তারা জানিয়েছেন, উন্নত প্রযুক্তিতে দক্ষ অনেক উচ্চশিক্ষিত ও ধনী তরুণরা দেশের বাইরে থেকে কুরিয়ার সার্ভিসের মাধ্যমে পার্সেলে অত্যাধুনিক মাদক দেশে এনে বিক্রি করছেন। চড়া দামে বিক্রি হচ্ছে ইয়াবা, আইস ও মলি। ইদানীং বেশি ধরা পড়ছে ইয়াবা, আইস (ক্রিস্টাল মেথ), মলি, কোকেন ও টেট্রাহাইড্রো ক্যানাবিনলযুক্ত কুশ। এ ছাড়া রয়েছে ফেনসিডিল, হেরোইন, সিডাকসিন, ইনোকট্রিন, মরফিন, মেথাডন, বিয়ার, ক্যানাবিস রেসিন, অ্যাবসলিউট অ্যালকোহল, ভেষজ ক্যানাবিস, গাঁজা ও দেশি-বিদেশি মদ।

উচ্চশিক্ষিত তরুণরা মাদক কারবারে ইংল্যান্ডে পড়াশোনা শেষ করে চকলেটের প্যাকেটের মাধ্যমে বিশেষ কায়দায় ভয়ানক মাদক মলি দেশে সরবরাহ করতেন এক দল তরুণ। সেগুলো পোস্ট অফিস ও বিভিন্ন মাধ্যমে দেশের বিভিন্ন প্রান্তে ছড়িয়ে দেওয়া হতো। বিভিন্ন মাদক চক্র ছড়িয়ে দেওয়ার এই কাজটি করত। এমন একটি চক্রের পাঁচ সদস্যকে সম্প্রতি গ্রেপ্তার করে মাদকদ্রব্য নিয়ন্ত্রণ অধিদপ্তর। তাদের কাছ থেকে উদ্ধার করা হয় ইয়াবার চেয়ে ভয়ানক মাদক ‘এমডিএমএ’, যার বাণিজ্যিক নাম এক্সটাসি, মলি বা হ্যাপি। এই মাদক ডিজে পার্টিতে বেশি ব্যবহার হয়ে থাকে। এই মাদক সেবন করলে শরীরে উত্তেজনার সৃষ্টি হয় এবং অনেক সময় ধরে নাচানাচি করা যায়। মলি বা এমডিএমএর দাম আন্তর্জাতিক বাজারে ডলারে নির্ধারিত হয়। তবে বাংলাদেশে ৫ হাজার থেকে ১০ হাজার টাকায় বিক্রি হয়।

গত বছরের ৪ ডিসেম্বর উচ্চমূল্যের অত্যাধুনিক মাদকসহ তিন ধনী তরুণকে গ্রেপ্তার করে মাদকদ্রব্য নিয়ন্ত্রণ অধিদপ্তরের ঢাকা মেট্রো (উত্তর) কার্যালয়। গুলশান ও পল্টন এলাকায় অভিযান চালিয়ে তাদের গ্রেপ্তার করা হয়। ওই তরুণদের কাছ থেকে টেট্রাহাইড্রো ক্যানাবিনলযুক্ত কুশ, ক্যানাবিনলযুক্ত কান্ডি, তরল ক্যানাবিনয়েড, ম্যাজিক মাশরুম ও বিদেশি মদ উদ্ধার করা হয়।

মাদকদ্রব্য নিয়ন্ত্রণ অধিদপ্তরের কর্মকর্তারা জানান, থাইল্যান্ড ও কানাডা থেকে এসব মাদক আনতেন ওই তরুণরা। অ্যাপভিত্তিক বিভিন্ন গ্রুপের সদস্যদের কাছে কৌশলে মাদক পৌঁছে দিতেন তারা। গুলশান, বনানীসহ ঢাকার বিভিন্ন এলাকার ধনাঢ্য তরুণ-তরুণী এসব মাদক কিনে সেবন করেন।

এ ছাড়া গত বছরের ১৯ অক্টোবর রাজধানীর বিভিন্ন এলাকায় অভিযান চালিয়ে বিপুল পরিমাণ ক্যানাবিনলযুক্ত কুশ (টেট্রাহাইড্রো ক্যানাবিনলযুক্ত মাদক), এক্সটাসি/হ্যাপি ড্রাগ, সিসা ও ইয়াবা জব্দ করে মাদকদ্রব্য নিয়ন্ত্রণ অধিদপ্তরের ঢাকা মেট্রো কার্যালয় (উত্তর)। অভিযানে সাত তরুণকে গ্রেপ্তার করা হয়। এসব মাদকের মধ্যে কানাডা থেকে আমদানি করা হয় কুশ, যুক্তরাজ্য থেকে আমদানি করা হয় এক্সটাসি/হ্যাপি ড্রাগ। এ রকম আরও বেশ কিছু মাদকবিরোধী অভিযান চালায় পুলিশ, র‌্যাবসহ আইনশৃঙ্খলা বাহিনী।কোন পথে সমাধান, কী বলছেন বিশেষজ্ঞরা।পার্সেলে আসা মাদক ঠেকানোর বিষয়ে সাবেক পুলিশ মহাপরিদর্শক (আইজিপি) আব্দুল কাইয়ুম খবরের কাগজকে বলেন, দেশি-বিদেশি কুরিয়ার সার্ভিসগুলোর সঙ্গে মাদক নিয়ন্ত্রণ অধিদপ্তরের যোগাযোগ বাড়াতে হবে। এ ছাড়া আলাদা টিম গঠন করে কাজ করা যেতে পারে। অপরাধীরা যেহেতু প্রযুক্তি ব্যবহার করছে, সে ক্ষেত্রে কর্মকর্তাদেরও দক্ষতা বাড়ানো জরুরি। তবে এ ক্ষেত্রে নিরপরাধ কোনো ব্যক্তি যাতে হয়রানির শিকার না হন সেদিকেও খেয়াল রাখতে হবে।

আব্দুল কাইয়ুম বলেন, এ ধরনের অপকর্ম ঠেকানো খুব কঠিন কাজ। এ ক্ষেত্রে গোয়েন্দা নজরদারি বাড়ানোর কোনো বিকল্প নেই।

এ প্রসঙ্গে সমাজ ও অপরাধ বিশেষজ্ঞ ড. তৌহিদুল হক খবরের কাগজকে বলেন, বাংলাদেশে উচ্চশিক্ষিত তরুণদের অনেকেই নানা কারণে মাদকের সঙ্গে জড়িয়ে পড়ছেন। তবে এদের মধ্যে মাদক কারবারে জড়িত থাকার তুলনায় সেবনকারীর সংখ্যা অনেক বেশি।

ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের সমাজকল্যাণ ও গবেষণা ইনস্টিটিউটের এই সহযোগী অধ্যাপক আরও বলেন, ‘আমাদের অনেকেই মনে করি, যারা উচ্চশিক্ষিত তারা কোনো অপরাধমূলক কর্মকাণ্ডের সঙ্গে সম্পৃক্ত হন না। জীবন ও সমাজের জন্য ক্ষতিকর এ ধরনের কাজের সঙ্গে তারা জড়িত হবেন না। কিন্তু মানুষের এসব ভাবনা ভুল প্রমাণিত হচ্ছে। মাদকের সহজলভ্যতার কারণে দেশে-বিদেশে বসে অনলাইন বা সরাসরি অনেকেই এখন এই অপকর্মে সম্পৃক্ত হচ্ছেন। অর্থের লোভ এবং পারিপার্শ্বিক নানা অবস্থার কারণে এমন ঘটনা ঘটছে। অনেক সময় যেকোনো সম্পর্কের বিচ্ছেদ ও নানা হতাশা থেকে মাদকসেবন এবং পরে ব্যবসায় জড়িয়ে যাচ্ছেন শিক্ষিত তরুণরা। এখন মাদক কারবার নিয়ন্ত্রণে অভিযান বাড়াতে হবে। সাধারণ মানুষকে মাদকের ক্ষতিকর দিকগুলো সম্পর্কে সুনির্দিষ্টভাবে জানাতে হবে। এ ছাড়া পারিবারিক ও সামাজিক দায়বদ্ধতা সৃষ্টিতে প্রচার বাড়াতে হবে।’

এ বিষয়ে জাতীয় মানসিক স্বাস্থ্য ইনস্টিটিউট ও হাসপাতালের মনোরোগ বিশেষজ্ঞ রেজিস্ট্রার ডা. মো. তৈয়বুর রহমান রয়েল খবরের কাগজকে বলেন, উচ্চবিত্ত পরিবারগুলোতে যেহেতু অর্থের সহজলভ্যতা থাকে, ফলে নিত্যনতুন ‘অ্যাডভেঞ্চার’ বা মাদক গ্রহণ তাদের কাছে সাধারণ ঘটনা হয়ে গেছে। যারা মাদকাসক্ত তারা সাধারণত মাদকের ব্যয় মেটানোর জন্য অনেক ক্ষেত্রে মাদকের কারবারে জড়িয়ে পড়ছেন। উচ্চবিত্ত অনেক পরিবারে সামাজিক মূল্যবোধ ও অনুশাসনের ঘাটতি দেখা যায়, যে কারণে এই ধরনের অনৈতিক কাজে জড়িয়ে পড়ছেন উচ্চশিক্ষিত তরুণরা।

মাদক নিয়ে যা বলছে ডিএনসি চলতি বছরের প্রথম ছয় মাসে মাদকদ্রব্য নিয়ন্ত্রণ অধিদপ্তরের (ডিএনসি) অর্থায়নে মাদকসেবীদের ওপর একটি গবেষণা চালিয়েছে বাংলাদেশ মেডিকেল বিশ্ববিদ্যালয়। সেই গবেষণার তথ্যমতে, দেশে বর্তমানে মাদকসেবীর সংখ্যা ৮৩ লাখ। এর মধ্যে ৭৭ লাখ ৬০ হাজার পুরুষ, পৌনে ৩ লাখ নারী ও আড়াই লাখের মতো শিশু রয়েছে। এই ৮৩ লাখের ৬৩ শতাংশই তরুণ ও কিশোর-কিশোরী।

এ প্রসঙ্গে মাদকদ্রব্য নিয়ন্ত্রণ অধিদপ্তরের (ঢাকা মেট্রো দক্ষিণ) উপপরিচালক মো. মানজুরুল ইসলাম সারাক্ষণ বার্তাকে বলেন, দেশে বিভিন্ন কুরিয়ারের মাধ্যমে পার্সেলে মাদক আসছে। বিশ্বের বিভিন্ন উন্নত দেশ থেকে এখন দেশে চোরাইপথে মাদক আনছেন উচ্চশিক্ষিত তরুণরা। বিদেশে পড়াশোনা করতে যাওয়া তরুণরা অভিভাবকহীন হয়ে মাদক কারবারে জড়িয়ে পড়ছেন। এ ছাড়া তথ্যপ্রযুক্তি ব্যবহারের মাধ্যমে লাভজনক এই কারবারে জড়িতদের সংখ্যা বাড়ছে। তিনি বলেন, ‘দেশি-বিদেশি কুরিয়ার সার্ভিসগুলোর সঙ্গে প্রতিনিয়ত আমাদের যোগাযোগ আছে। এ ছাড়া গোয়েন্দা নজরদারিও বাড়ানো হয়েছে। বিদেশ থেকে মাদক আসা ঠেকাতে তৎপর রয়েছেন মাদক কর্মকর্তারা।’

Tag :
About Author Information

GOURANGA BOSE

জনপ্রিয় সংবাদ

মাগুরা ২৫০ শয্যা বিশিষ্ট হাসপাতালে গোপন টেন্ডারে ৫০ লাখ টাকা আত্মসাৎ ।

শিক্ষিত তরুণরা কেন অন্ধকারের পথে ?

আপডেট সময় : ০৮:৪৫:০৫ অপরাহ্ন, শনিবার, ৪ অক্টোবর ২০২৫

 

অপরাধ জগতের মানুষ বেশির ভাগ ক্ষেত্রে মরণনেশা বা মাদক কারবারে সম্পৃক্ত বলে শোনা যায়। এদের বেশির ভাগই শিক্ষার আলো থেকে বঞ্চিত। জন্ম-বেড়ে ওঠা হয়তো কোনো বস্তিতে বা মাদকের আখড়ায়। সেখান থেকে জড়িয়ে পড়ে মাদক চক্রে। দারিদ্র্য, শিক্ষার অভাব এবং প্রতিকূল পরিবেশ তাদের এই পথে ঠেলে দেয়। কিন্তু উদ্বেগের বিষয় হচ্ছে, বর্তমান সমাজের অনেক উচ্চবিত্ত পরিবারের সন্তান বা উচ্চশিক্ষিত তরুণরাও জড়িয়ে পড়ছেন ভয়ানক মাদকের কারবারে।

সংশ্লিষ্টরা বলছেন, চিহ্নিত অপরাধীদের পাশাপাশি বর্তমানে অনেক শিক্ষিত তরুণ-তরুণীও মাদক কারবারে জড়িয়ে পড়ছেন। প্রথমে বন্ধুদের সঙ্গে মাদক সেবন, এরপর চক্রের সদস্য হয়ে মাদক কারবারে জড়িয়ে পড়েন তারা। গত দুই বছরে মাদকদ্রব্য নিয়ন্ত্রণ অধিদপ্তরসহ আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর হাতে ধরা পড়েছেন এ রকম শতাধিক উচ্চশিক্ষিত তরুণ। কিন্তু এমন সম্ভাবনাময় উচ্চশিক্ষিত তরুণরা কেন মাদক কারবারের অন্ধকার পথে পা বাড়াচ্ছেন, সেটিও বড় প্রশ্ন হয়ে দেখা দিচ্ছে।

বিশেষজ্ঞরা বলছেন, ভৌগোলিক কারণে বাংলাদেশ এখন আন্তর্জাতিক মাদক পাচারকারীদের অন্যতম রুট ও বাজারে পরিণত হয়েছে। এখন তরুণরা কানাডা, ইংল্যান্ড, ইউরোপ ও আমেরিকা থেকে মাদক এনে দেশে বাজার তৈরির চেষ্টা করছেন। এ ছাড়া মেক্সিকো, নাইজেরিয়া, ক্যামেরুন, ভারত, মায়ানমারসহ আরও একাধিক দেশ হয়ে এ দেশে আসছে মাদক। তবে এটা নিয়ন্ত্রণ করা না গেলে দেশ ও ভবিষ্যতের সম্ভাবনাময় প্রজন্মের জন্য হুমকি হয়ে দেখা দেবে। এ জন্য পারিবারিক ও সামাজিকভাবে প্রতিরোধের পাশাপাশি আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর কঠোর অভিযান প্রয়োজন।

মাদকদ্রব্য নিয়ন্ত্রণ অধিদপ্তরের কর্মকর্তারা জানিয়েছেন, উন্নত প্রযুক্তিতে দক্ষ অনেক উচ্চশিক্ষিত ও ধনী তরুণরা দেশের বাইরে থেকে কুরিয়ার সার্ভিসের মাধ্যমে পার্সেলে অত্যাধুনিক মাদক দেশে এনে বিক্রি করছেন। চড়া দামে বিক্রি হচ্ছে ইয়াবা, আইস ও মলি। ইদানীং বেশি ধরা পড়ছে ইয়াবা, আইস (ক্রিস্টাল মেথ), মলি, কোকেন ও টেট্রাহাইড্রো ক্যানাবিনলযুক্ত কুশ। এ ছাড়া রয়েছে ফেনসিডিল, হেরোইন, সিডাকসিন, ইনোকট্রিন, মরফিন, মেথাডন, বিয়ার, ক্যানাবিস রেসিন, অ্যাবসলিউট অ্যালকোহল, ভেষজ ক্যানাবিস, গাঁজা ও দেশি-বিদেশি মদ।

উচ্চশিক্ষিত তরুণরা মাদক কারবারে ইংল্যান্ডে পড়াশোনা শেষ করে চকলেটের প্যাকেটের মাধ্যমে বিশেষ কায়দায় ভয়ানক মাদক মলি দেশে সরবরাহ করতেন এক দল তরুণ। সেগুলো পোস্ট অফিস ও বিভিন্ন মাধ্যমে দেশের বিভিন্ন প্রান্তে ছড়িয়ে দেওয়া হতো। বিভিন্ন মাদক চক্র ছড়িয়ে দেওয়ার এই কাজটি করত। এমন একটি চক্রের পাঁচ সদস্যকে সম্প্রতি গ্রেপ্তার করে মাদকদ্রব্য নিয়ন্ত্রণ অধিদপ্তর। তাদের কাছ থেকে উদ্ধার করা হয় ইয়াবার চেয়ে ভয়ানক মাদক ‘এমডিএমএ’, যার বাণিজ্যিক নাম এক্সটাসি, মলি বা হ্যাপি। এই মাদক ডিজে পার্টিতে বেশি ব্যবহার হয়ে থাকে। এই মাদক সেবন করলে শরীরে উত্তেজনার সৃষ্টি হয় এবং অনেক সময় ধরে নাচানাচি করা যায়। মলি বা এমডিএমএর দাম আন্তর্জাতিক বাজারে ডলারে নির্ধারিত হয়। তবে বাংলাদেশে ৫ হাজার থেকে ১০ হাজার টাকায় বিক্রি হয়।

গত বছরের ৪ ডিসেম্বর উচ্চমূল্যের অত্যাধুনিক মাদকসহ তিন ধনী তরুণকে গ্রেপ্তার করে মাদকদ্রব্য নিয়ন্ত্রণ অধিদপ্তরের ঢাকা মেট্রো (উত্তর) কার্যালয়। গুলশান ও পল্টন এলাকায় অভিযান চালিয়ে তাদের গ্রেপ্তার করা হয়। ওই তরুণদের কাছ থেকে টেট্রাহাইড্রো ক্যানাবিনলযুক্ত কুশ, ক্যানাবিনলযুক্ত কান্ডি, তরল ক্যানাবিনয়েড, ম্যাজিক মাশরুম ও বিদেশি মদ উদ্ধার করা হয়।

মাদকদ্রব্য নিয়ন্ত্রণ অধিদপ্তরের কর্মকর্তারা জানান, থাইল্যান্ড ও কানাডা থেকে এসব মাদক আনতেন ওই তরুণরা। অ্যাপভিত্তিক বিভিন্ন গ্রুপের সদস্যদের কাছে কৌশলে মাদক পৌঁছে দিতেন তারা। গুলশান, বনানীসহ ঢাকার বিভিন্ন এলাকার ধনাঢ্য তরুণ-তরুণী এসব মাদক কিনে সেবন করেন।

এ ছাড়া গত বছরের ১৯ অক্টোবর রাজধানীর বিভিন্ন এলাকায় অভিযান চালিয়ে বিপুল পরিমাণ ক্যানাবিনলযুক্ত কুশ (টেট্রাহাইড্রো ক্যানাবিনলযুক্ত মাদক), এক্সটাসি/হ্যাপি ড্রাগ, সিসা ও ইয়াবা জব্দ করে মাদকদ্রব্য নিয়ন্ত্রণ অধিদপ্তরের ঢাকা মেট্রো কার্যালয় (উত্তর)। অভিযানে সাত তরুণকে গ্রেপ্তার করা হয়। এসব মাদকের মধ্যে কানাডা থেকে আমদানি করা হয় কুশ, যুক্তরাজ্য থেকে আমদানি করা হয় এক্সটাসি/হ্যাপি ড্রাগ। এ রকম আরও বেশ কিছু মাদকবিরোধী অভিযান চালায় পুলিশ, র‌্যাবসহ আইনশৃঙ্খলা বাহিনী।কোন পথে সমাধান, কী বলছেন বিশেষজ্ঞরা।পার্সেলে আসা মাদক ঠেকানোর বিষয়ে সাবেক পুলিশ মহাপরিদর্শক (আইজিপি) আব্দুল কাইয়ুম খবরের কাগজকে বলেন, দেশি-বিদেশি কুরিয়ার সার্ভিসগুলোর সঙ্গে মাদক নিয়ন্ত্রণ অধিদপ্তরের যোগাযোগ বাড়াতে হবে। এ ছাড়া আলাদা টিম গঠন করে কাজ করা যেতে পারে। অপরাধীরা যেহেতু প্রযুক্তি ব্যবহার করছে, সে ক্ষেত্রে কর্মকর্তাদেরও দক্ষতা বাড়ানো জরুরি। তবে এ ক্ষেত্রে নিরপরাধ কোনো ব্যক্তি যাতে হয়রানির শিকার না হন সেদিকেও খেয়াল রাখতে হবে।

আব্দুল কাইয়ুম বলেন, এ ধরনের অপকর্ম ঠেকানো খুব কঠিন কাজ। এ ক্ষেত্রে গোয়েন্দা নজরদারি বাড়ানোর কোনো বিকল্প নেই।

এ প্রসঙ্গে সমাজ ও অপরাধ বিশেষজ্ঞ ড. তৌহিদুল হক খবরের কাগজকে বলেন, বাংলাদেশে উচ্চশিক্ষিত তরুণদের অনেকেই নানা কারণে মাদকের সঙ্গে জড়িয়ে পড়ছেন। তবে এদের মধ্যে মাদক কারবারে জড়িত থাকার তুলনায় সেবনকারীর সংখ্যা অনেক বেশি।

ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের সমাজকল্যাণ ও গবেষণা ইনস্টিটিউটের এই সহযোগী অধ্যাপক আরও বলেন, ‘আমাদের অনেকেই মনে করি, যারা উচ্চশিক্ষিত তারা কোনো অপরাধমূলক কর্মকাণ্ডের সঙ্গে সম্পৃক্ত হন না। জীবন ও সমাজের জন্য ক্ষতিকর এ ধরনের কাজের সঙ্গে তারা জড়িত হবেন না। কিন্তু মানুষের এসব ভাবনা ভুল প্রমাণিত হচ্ছে। মাদকের সহজলভ্যতার কারণে দেশে-বিদেশে বসে অনলাইন বা সরাসরি অনেকেই এখন এই অপকর্মে সম্পৃক্ত হচ্ছেন। অর্থের লোভ এবং পারিপার্শ্বিক নানা অবস্থার কারণে এমন ঘটনা ঘটছে। অনেক সময় যেকোনো সম্পর্কের বিচ্ছেদ ও নানা হতাশা থেকে মাদকসেবন এবং পরে ব্যবসায় জড়িয়ে যাচ্ছেন শিক্ষিত তরুণরা। এখন মাদক কারবার নিয়ন্ত্রণে অভিযান বাড়াতে হবে। সাধারণ মানুষকে মাদকের ক্ষতিকর দিকগুলো সম্পর্কে সুনির্দিষ্টভাবে জানাতে হবে। এ ছাড়া পারিবারিক ও সামাজিক দায়বদ্ধতা সৃষ্টিতে প্রচার বাড়াতে হবে।’

এ বিষয়ে জাতীয় মানসিক স্বাস্থ্য ইনস্টিটিউট ও হাসপাতালের মনোরোগ বিশেষজ্ঞ রেজিস্ট্রার ডা. মো. তৈয়বুর রহমান রয়েল খবরের কাগজকে বলেন, উচ্চবিত্ত পরিবারগুলোতে যেহেতু অর্থের সহজলভ্যতা থাকে, ফলে নিত্যনতুন ‘অ্যাডভেঞ্চার’ বা মাদক গ্রহণ তাদের কাছে সাধারণ ঘটনা হয়ে গেছে। যারা মাদকাসক্ত তারা সাধারণত মাদকের ব্যয় মেটানোর জন্য অনেক ক্ষেত্রে মাদকের কারবারে জড়িয়ে পড়ছেন। উচ্চবিত্ত অনেক পরিবারে সামাজিক মূল্যবোধ ও অনুশাসনের ঘাটতি দেখা যায়, যে কারণে এই ধরনের অনৈতিক কাজে জড়িয়ে পড়ছেন উচ্চশিক্ষিত তরুণরা।

মাদক নিয়ে যা বলছে ডিএনসি চলতি বছরের প্রথম ছয় মাসে মাদকদ্রব্য নিয়ন্ত্রণ অধিদপ্তরের (ডিএনসি) অর্থায়নে মাদকসেবীদের ওপর একটি গবেষণা চালিয়েছে বাংলাদেশ মেডিকেল বিশ্ববিদ্যালয়। সেই গবেষণার তথ্যমতে, দেশে বর্তমানে মাদকসেবীর সংখ্যা ৮৩ লাখ। এর মধ্যে ৭৭ লাখ ৬০ হাজার পুরুষ, পৌনে ৩ লাখ নারী ও আড়াই লাখের মতো শিশু রয়েছে। এই ৮৩ লাখের ৬৩ শতাংশই তরুণ ও কিশোর-কিশোরী।

এ প্রসঙ্গে মাদকদ্রব্য নিয়ন্ত্রণ অধিদপ্তরের (ঢাকা মেট্রো দক্ষিণ) উপপরিচালক মো. মানজুরুল ইসলাম সারাক্ষণ বার্তাকে বলেন, দেশে বিভিন্ন কুরিয়ারের মাধ্যমে পার্সেলে মাদক আসছে। বিশ্বের বিভিন্ন উন্নত দেশ থেকে এখন দেশে চোরাইপথে মাদক আনছেন উচ্চশিক্ষিত তরুণরা। বিদেশে পড়াশোনা করতে যাওয়া তরুণরা অভিভাবকহীন হয়ে মাদক কারবারে জড়িয়ে পড়ছেন। এ ছাড়া তথ্যপ্রযুক্তি ব্যবহারের মাধ্যমে লাভজনক এই কারবারে জড়িতদের সংখ্যা বাড়ছে। তিনি বলেন, ‘দেশি-বিদেশি কুরিয়ার সার্ভিসগুলোর সঙ্গে প্রতিনিয়ত আমাদের যোগাযোগ আছে। এ ছাড়া গোয়েন্দা নজরদারিও বাড়ানো হয়েছে। বিদেশ থেকে মাদক আসা ঠেকাতে তৎপর রয়েছেন মাদক কর্মকর্তারা।’