বাংলাদেশের রাজনৈতিক ইতিহাসের পরতে পরতে জড়িয়ে আছে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় (ঢাবি) কেন্দ্রীয় ছাত্র সংসদ (ডাকসু)। অবিভক্ত ভারতের ছাত্র রাজনীতি থেকে শুরু করে একাত্তরের স্বাধীনতার পূর্বাপর রাজপথের আন্দোলন-সংগ্রামের নানা বাঁকে সামনে থেকে নেতৃত্ব দিয়েছে এ প্রতিষ্ঠানটি। জাতির সংকটকালে বারবার দেখিয়েছে মুক্তির দিশা। শতবর্ষী এ ডাকসু যেমন বহু মন্ত্রী-এমপির জন্ম দিয়েছে, আবার ডাকসুর ছাত্রনেতা থেকে অনেকে পরবর্তীকালে হয়ে উঠেছেন জাতীয় নেতা।
বাংলাদেশের ছাত্র রাজনীতির ইতিহাসে এক গৌরবোজ্জ্বল প্রতিষ্ঠান ডাকসু। ১৯২১ সালে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় প্রতিষ্ঠার পরের বছরই ১৯২২ সালের ১ ডিসেম্বর কার্জন হলে শিক্ষকদের এক সভায় ১৯২৩-২৪ শিক্ষাবর্ষে ‘ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় ছাত্র সংসদ’ গঠনের সিদ্ধান্ত হয়। ১৯২৩ সালের ১৯ জানুয়ারি বিশ্ববিদ্যালয়ের নির্বাহী পরিষদ সিদ্ধান্তটি অনুমোদন করে।
১৯২৫ সালের ৩০ অক্টোবর সংসদের সাধারণ সভায় গঠনতন্ত্রের খসড়া অনুমোদিত হয় এবং বিশ্ববিদ্যালয়ের নির্বাহী পরিষদের অনুমোদনের পর তা কার্যকর হয়। এ ছাত্র সংসদের প্রথম ১৯২৪-২৫ মেয়াদে সহ-সভাপতি (ভিপি) মমতাজ উদ্দিন আহমেদ ও সাধারণ সম্পাদক (জিএস) ছিলেন যোগেন্দ্রনাথ সেনগুপ্ত। পরবর্তী বছর ১৯২৫-২৬ মেয়াদে মমতাজ উদ্দিন আহমেদ ফের ভিপি ও জিএস নির্বাচিত হন এ কে মুখার্জি (ভারপ্রাপ্ত অবনী ভূষণ রুদ্র সংক্ষেপে এ বি রুদ্র)।
এরপর ১৯২৭-২৮ মেয়াদে জিএস বি কে অধিকারী, ১৯২৮-২৯ মেয়াদে ভিপি এএম আজহারুল ইসলাম ও জিএস হন এস চক্রবর্তী। ১৯২৯-৩০ মেয়াদে ভিপি রমণী কান্ত ভট্টাচার্য ও জিএস হিসেবে দায়িত্ব পালন করেন কাজী রহমত আলী ও আতাউর রহমান
১৯৫৩-৫৪ শিক্ষাবর্ষে গঠনতন্ত্র সংশোধনের মাধ্যমে সংসদের নাম পরিবর্তন করে রাখা হয় ‘ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় কেন্দ্রীয় ছাত্র সংসদ’ বা ডাকসু। সেটিই ছিল প্রথমবার সরাসরি ভোটে নির্বাচিত ডাকসু। ওই নির্বাচনে ভিপি হন এস এ বারী এবং জিএস হন জুলমত আলী খান
পরবর্তীকালে ১৯৩২-৩৪ দুই মেয়াদে জিএস ভবেশ চক্রবর্তী, ১৯৩৫-৩৭ দুই মেয়াদে জিএস এ এইচ এম এ কাদের, ১৯৩৮-৩৯ মেয়াদে জিএস আব্দুল আওয়াল খান, ১৯৪১-৪২ মেয়াদে জিএস আব্দুর রহিম, ১৯৪৫-৪৬ মেয়াদে ভিপি আহমদুল কবির (ভারপ্রাপ্ত ফরিদ আহমেদ) ও জিএস সুধীর দত্ত, ১৯৪৬-৪৭ মেয়াদে ভিপি ফরিদ আহমেদ ও জিএস নির্বাচিত হন সুধীর দত্ত। ১৯৪৭-৪৮ মেয়াদে ভিপি অরবিন্দ বোস ও জিএস নির্বাচিত হন গোলাম আযম।
১৯৫৩-৫৪ শিক্ষাবর্ষে গঠনতন্ত্র সংশোধনের মাধ্যমে সংসদের নাম পরিবর্তন করে রাখা হয় ‘ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় কেন্দ্রীয় ছাত্র সংসদ’ বা ডাকসু। সেটিই ছিল প্রথমবার সরাসরি ভোটে নির্বাচিত ডাকসু। ওই নির্বাচনে ভিপি হন এস এ বারী এবং জিএস হন জুলমত আলী খান (ভারপ্রাপ্ত ফরিদ আহমেদ)।
এরপর ধাপে ধাপে ডাকসুর নির্বাচন নিয়মিতভাবে অনুষ্ঠিত হতে থাকে। পাকিস্তান আমলে ১৯৫৩ সাল থেকে ১৯৭১ সাল পর্যন্ত মোট ২৯ বার ডাকসু নির্বাচন অনুষ্ঠিত হয়। এসময়ের মধ্যে ভিপি ও জিএস পদে ডাকসুর নেতৃত্বে আসেন নিরোদ বিহারী নাগ, আব্দুর রব চৌধুরী, একরামুল হক, শাহ আলী হোসেন, বদরুল আলম, ফজলী হোসেন, আবুল হোসেন, এ টি এম মেহেদী, আমিনুল ইসলাম তুলা, আশরাফ উদ্দিন মকবুল, বেগম জাহানারা আক্তার, অমূল্য কুমার, এস এম রফিকুল হক, এনায়েতুর রহমান, শ্যামাপ্রসাদ ঘোষ, কে এম ওবায়েদুর রহমান।
স্বাধীনতা-পূর্ববর্তীকালে রাশেদ খান মেনন, মতিয়া চৌধুরী, বোরহানউদ্দিন, আসাফউদ্দৌলা, ফেরদৌস আহমেদ কোরেশী, শফি আহমেদ, মাহফুজা খানম, মোরশেদ আলী, তোফায়েল আহমেদ, নাজিম কামরান চৌধুরী, আ স ম আবদুর রব ও আব্দুল কুদ্দুস মাখন ডাকসুতে নেতৃত্ব দেন। যারা প্রত্যেকেই পরবর্তীকালে জাতীয় রাজনীতিতে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখেন।
১৯৭১ সালে মহান মুক্তিযুদ্ধের পর স্বাধীন বাংলাদেশের প্রথম ডাকসু নির্বাচন অনুষ্ঠিত হয় ১৯৭২ সালে। সেই নির্বাচনে ভিপি নির্বাচিত হন বাংলাদেশ ছাত্র ইউনিয়নের মুজাহিদুল ইসলাম সেলিম এবং জিএস হন মাহবুব জামান।এরপর ১৯৭৯, ১৯৮০ ও ১৯৮২ সালে ধারাবাহিকভাবে তিনটি নির্বাচন অনুষ্ঠিত হয়। এরমধ্যে ১৯৭৯ ও ১৯৮০ সালের টানা দুই মেয়াদে ভিপি জাসদ ছাত্রলীগের মাহমুদুর রহমান মান্না এবং একই মেয়াদে টানা দুইবার জিএস নির্বাচিত হন বাসদ ছাত্রলীগের আখতারুজ্জামান। ১৯৮২ সালের নির্বাচনে ভিপি হন আখতারুজ্জামান এবং জিএস হন বাসদ ছাত্রলীগের জিয়া উদ্দীন আহমেদ বাবলু; তারা ১৯৮৯ সাল পর্যন্ত দায়িত্বে ছিলেন।
১৯৮৯-৯০ মেয়াদে ডাকসুর ভিপি হিসেবে দায়িত্ব পালন করেন ছাত্রলীগের সুলতান মোহাম্মদ মনসুর আহমেদ এবং জিএস হন মুশতাক আহমেদ। ১৯৯০ সালের ৬ জুন অনুষ্ঠিত নির্বাচনে দুই ছাত্রদল নেতা আমানউল্লাহ আমান ভিপি এবং খায়রুল কবির খোকন জিএস নির্বাচিত হন। দীর্ঘ প্রায় তিন দশক পর ২০১৯ সালে ডাকসু নির্বাচনে ছাত্র অধিকার পরিষদের নুরুল হক নুর ভিপি এবং ছাত্রলীগের গোলাম রব্বানী জিএস নির্বাচিত হন।
১৯২৩ সাল থেকে ২০১৯ সাল পর্যন্ত ডাকসুতে মোট ৩৭টি নির্বাচন অনুষ্ঠিত হয়েছে। সবশেষ ডাকসু নির্বাচন হয়েছিল প্রায় ছয় বছর আগে। এরপর বিভিন্ন সময়ে ডাকসু নির্বাচনের উদ্যোগ নেওয়া হলেও তা আর বাস্তবায়িত হয়নি।তবে ছাত্র-জনতার জুলাই গণঅভুত্থান পরবর্তী সময়ে ডাকসু নির্বাচনের বিষয়টি ফের আলোচনায় আসে। এরই পরিপ্রেক্ষিতে গত মঙ্গলবার (২৯ জুলাই) ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের সিনেট ভবনে ৩৮তম ডাকসু নির্বাচনের তফসিল ঘোষণা করা হয়। ঘোষিত তফসিল অনুযায়ী, ডাকসু নির্বাচনের ভোটগ্রহণ অনুষ্ঠিত হবে আগামী ৯ সেপ্টেম্বর।
ডাকসু নির্বাচনের দীর্ঘ এ ইতিহাস শুধু শিক্ষাঙ্গনের নয়, বরং বাংলাদেশের রাজনৈতিক ইতিহাসেরও গুরুত্বপূর্ণ অধ্যায়। বহু জাতীয় নেতা, মন্ত্রী ও বরেণ্য ব্যক্তিত্বের জন্ম দিয়েছে এই ডাকসু। যাদের রাজনৈতিক অভিষেক হয়েছিল এ মঞ্চ থেকেই। তবে ১৯৯০ সালের পর টানা ২৮ বছর নির্বাচন বন্ধ থাকায় ডাকসুর সাংবিধানিক কার্যক্রম ও গণতান্ত্রিক চর্চা দীর্ঘ স্থবিরতার মধ্যে পড়ে।
১৯২৩ সাল থেকে ২০১৯ সাল পর্যন্ত ডাকসুতে মোট ৩৭টি নির্বাচন অনুষ্ঠিত হয়েছে। সবশেষ ডাকসু নির্বাচন হয়েছিল প্রায় ছয় বছর আগে। এরপর বিভিন্ন সময়ে ডাকসু নির্বাচনের উদ্যোগ নেওয়া হলেও তা আর বাস্তবায়িত হয়নি
সবশেষ ২০১৯ সালে যে ডাকসু নির্বাচন অনুষ্ঠিত হয়, সেটির স্বচ্ছতা নিয়েও রয়েছে নানান প্রশ্ন। অর্ধ যুগ পেরিয়ে আবারও ডাকসু নির্বাচনের হাওয়া লেগেছে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় ক্যাম্পাসে। ছাত্র রাজনীতিকরা মনে করছেন, আসন্ন নির্বাচন বিশ্ববিদ্যালয়ের গণতান্ত্রিক ঐতিহ্য পুনরুদ্ধারের জন্য হতে পারে অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ।
ডাকসু থেকে যারা হয়ে উঠেছিলেন জাতীয় নেতা। তাদের মধ্যে অন্যতম হলেন রাশেদ খান মেনন (১৯৬৩-৬৪) একজন প্রথিতযশা কমিউনিস্ট নেতা ও শেখ মুজিবুর রহমানের সময়কার উল্লেখযোগ্য ছাত্রনেতা। ডাকসুর ভিপি হিসেবে নেতৃত্ব দেওয়া এই বামপন্থি নেতা বাংলাদেশের ওয়ার্কার্স পার্টির বর্তমান সভাপতি এবং বাংলাদেশ জাতীয় সংসদে বেশ কয়েকবার নির্বাচিত সংসদ সদস্য। তিনি আওয়ামী লীগ নেতৃত্বাধীন মহাজোট সরকারের মন্ত্রী হিসেবেও দায়িত্ব পালন করেন।
দেশের বামপন্থি রাজনীতির এই অগ্রজজন ছাত্র-জনতার অভ্যুত্থান পরবর্তীকালে ২০২৪ সালের আগস্টে বেশ কয়েকটি মামলায় গ্রেফতার হন। তিনি বর্তমানে কারাগারে আছেন।
আ স ম আবদুর রব (১৯৭০-৭১) ছিলেন মুক্তিযুদ্ধকালীন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের মানচিত্র খচিত পতাকা উত্তোলনের গুরুত্বপূর্ণ নেতা। তিনি ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের বটতলায় শেখ মুজিবুর রহমানের হাতে বাংলাদেশের পতাকা তুলে দেন। ১৯৭১ সালের ৩ মার্চ পল্টন ময়দানে শেখ মুজিবকে ‘জাতির জনক’ উপাধি দেন সাবেক এ ছাত্রলীগ নেতা।
তিনি বর্তমানে জাতীয় সমাজতান্ত্রিক দল (জেএসডি)-এর সভাপতি হিসেবে দায়িত্ব পালন করছেন এবং সামাজিক ও রাজনীতির মহলে সক্রিয় অবস্থানে আছেন।
মুজাহিদুল ইসলাম সেলিম (১৯৭২-৭৩) স্বাধীন বাংলাদেশের প্রথম ডাকসু ভিপি। ছাত্র ইউনিয়নের প্রভাবশালী এ নেতার জাতীয় রাজনীতিতে উত্থানও ডাকসু থেকে। বামপন্থি ছাত্র রাজনীতি থেকে পরবর্তীকালে তিনি বাংলাদেশের কমিউনিস্ট পার্টি-সিপিবির সাধারণ সম্পাদক ও সভাপতির দায়িত্ব পালন করেন। বহু সামাজিক-সাংগঠনিক আন্দোলনের সফল এ নেতা এখনো দেশের বাম রাজনীতির জীবন্ত আলোকবর্তিকা। সাম্প্রতিক সময়ে রাজনীতিতে অপেক্ষাকৃত নীরব থাকলেও সিপিবিতে তার অবস্থান বরাবরই সুনির্দিষ্ট ছিল।
মাহমুদুর রহমান মান্না (১৯৭৯ ও ১৯৮০) দুইবার ডাকসুর ভিপি নির্বাচিত হয়ে ১৯৮০-এর দশকের ছাত্র রাজনীতিতে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখেন। বর্তমানে তিনি নাগরিক ঐক্যের সভাপতি এবং দেশের রাজনৈতিক ও নাগরিক অধিকারের বিভিন্ন আন্দোলনে সক্রিয়।
সুলতান মোহাম্মদ মনসুর আহমেদ (১৯৮৯‑৯০) ছিলেন স্বৈরশাসনবিরোধী আন্দোলনের একজন মুখ্য নেতা। বর্তমানে তিনি ড. কামাল হোসেনের গণফোরাম এবং জাতীয় রাজনীতির সঙ্গে যুক্ত। ডাকসুর সাবেক এ ভিপি আওয়ামী লীগের সাংগঠনিক সম্পাদক হিসেবেও দায়িত্ব পালন করেছেন।
আমানউল্লাহ আমান (১৯৯০-৯১) বর্তমানে বাংলাদেশ জাতীয়তাবাদী দল-বিএনপির চেয়ারপারসনের উপদেষ্টা হিসেবে দায়িত্ব পালন করছেন। ডাকসুর সাবেক এ ভিপি বিএনপির ঢাকা মহানগর উত্তরের আহ্বায়ক হিসেবেও দায়িত্ব পালন করেছেন।
নুরুল হক নুর (২০১৯‑২০) ‘ভিপি নুর’ নামেই বেশি পরিচিত। ২০১৮ সালে কোটা সংস্কার আন্দোলন চলাকালে ছাত্রসমাজের নজরে আসেন তিনি। পরে ডাকসুর ভিপি নির্বাচিত হন। এরপর তিনি গণঅধিকার পরিষদ নামে একটি নতুন রাজনৈতিক দল প্রতিষ্ঠাতা করেন। বর্তমানে দলটির সভাপতি হিসেবে দায়িত্ব পালন করছেন।