বিগত সরকারের আমলে ব্যাংকিং খাতে চলছিল যেন দুর্নীতির মহোৎসব।যে যেভাবে পারে অর্থ আত্মসাতের নেশায় উন্মত্ত হয়েছিল।
অনুসন্ধানের বরাতে দুদুক বলছে, এস আলমের ব্যাংক থেকে নেওয়া ঋণের অর্থ গেছে সিকদার পরিবারের স্বার্থ সংশ্লিষ্টদের কাছে।
সিকদার পরিবারের দুই ভাই রন হক সিকদার ও রিক হক সিকদার, এস আলম গ্রুপের চেয়ারম্যান এস আলম।
‘জালিয়াতির’ মাধ্যমে ফার্স্ট সিকিউরিটি ইসলামী ব্যাংকের ১১০ কোটি টাকা আত্মসাতের অভিযোগে সিকদার পরিবারের পাঁচ সদস্য এবং মোহাম্মদ সাইফুল আলম (এস আলম) ও তার স্ত্রীর বিরুদ্ধে মামলা করার সিদ্ধান্ত নিয়েছে দুর্নীতি দমন কমিশন (দুদক)।
মামলায় ব্যাংকের সাবেক কয়েকজন পরিচালকসহ মোট ২৬ জনকে আসামি করা হচ্ছে বলে সারাক্ষণ বার্তাকে জানিয়েছেন দুদকের মহাপরিচালক মো. আক্তার হোসেন।
মঙ্গলবার সংস্থার প্রধান কার্যালয়ে তিনি সাংবাদিকদের বলেন, “ঋণ গ্রহণে ক্ষমতার অপব্যবহার, অনিয়ম ও শর্তভঙ্গের মাধ্যমে নবীন গ্রাহক প্রতিষ্ঠান এস. কিউ. ট্রেনিং অ্যান্ড ডেভেলপমেন্ট এর কোনো বাস্তবসম্মত ঋণপ্রয়োজন না থাকার পরও প্রকল্প পরিদর্শন প্রতিবেদন ছাড়াই ঋণ অনুমোদন করা হয়।”
অনুসন্ধানে পাওয়া তথ্যের ভিত্তিতে তিনি বলেন, গ্রাহকের সক্ষমতা যাচাই না করে এবং প্রয়োজনীয় রেকর্ড পরীক্ষা ছাড়াই ওয়ার্ক অর্ডারের বিপরীতে ঋণ অনুমোদন ও বিতরণ করেছে ফার্স্ট সিকিউরিটি ইসলামী ব্যাংক। অনুসন্ধানে প্রমাণিত হয়েছে, এ অর্থ উত্তোলন, স্থানান্তর ও হস্তান্তরের মাধ্যমে ‘আত্মসাৎ’ করা হয়েছে।
এর সঙ্গে সংশ্লিষ্ট ক্ষমতাচ্যুত আওয়ামী লীগের সময়ে আলোচিত ও প্রভাবশালী সিকদার পরিবারের সদস্য রন হক সিকদার ও রিক হক সিকদারসহ তার অন্য ভাই-বোন, ফার্স্ট সিকিউরিটি ব্যাংকের ওই সময়ের চেয়ারম্যান ও আলোচিত শিল্প গ্রুপ এস আলমের চেয়ারম্যান এস আলমসহ ২৬ জনের বিরুদ্ধে মামলা করার সিদ্ধান্ত নেওয়ার তথ্য দেন দুদকের মহাপরিচালক।
তিনি বলেন, মামলায় ‘আত্মসাৎ’ করা অর্থের মধ্যে মূলধন ছিল ১১০ কোটি টাকা; যা সুদসহ মোট দাঁড়িয়েছে ২০৭ কোটি ৪২ লাখ টাকারও বেশি।
মামলার সম্ভাব্য আসামীরা হলেন- জয়নুল হক সিকদারের তিন ছেলে রন হক সিকদার, রিক হক সিকদার ও মমতাজুল হক সিকদার এবং দুই মেয়ে লিসা ফাতেমা হক সিকদার ও পারভীন হক সিকদার, ফার্স্ট সিকিউরিটি ব্যাংকের সাবেক চেয়ারম্যান এস আলম এবং তার স্ত্রী।
এ তালিকায় রয়েছেন- এস. কিউ. ট্রেডিং অ্যান্ড ডেভেলপারের স্বত্বাধিকারী সৈয়দ কামরুল ইসলাম, এম. এস. কনস্ট্রাকশন অ্যান্ড ডেভেলপারস ও ম্যাম ইমপেক্সের স্বত্বাধিকারী মো. সালাউদ্দিন এবং মাহবুব এন্টারপ্রাইজের স্বত্বাধিকারী সৈয়দ মাহবুব-ই-করিম।
এছাড়া ফার্স্ট সিকিউরিটি ইসলামী ব্যাংকের তৎকালীন ও সাবেক ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তা এবং পরিচালক সৈয়দ ওয়াসেক মো. আলী, এম. এম. মোস্তাফিজুর রহমান, মো. জহুরুল হক, আব্দুল আজিজ, মোহাম্মদ আব্দুল মালেক, আতিকুর নেছা, মোহাম্মদ ইসহাক, আহমদ মুক্তাদির আরিফ, খন্দকার ইফতেখার আহমদ, মমতাজ উদ্দিন আহমেদ, বদরুন নেছা, মো. ওয়াহিদুল আলম শেঠ, জামাল মোস্তফা চৌধুরী এবং অবসরপ্রাপ্ত লেফটেন্যান্ট জেনারেল মোল্লা ফজলে আকবর ও ফারজানা পারভীনকে আসামি করা হতে পারে।
সম্ভাব্য আসামির তালিকায় মো. শেখ আলম ও মনীশঙ্কর বিশ্বাস নামের দুইজনও রয়েছেন।
দুদকের অনুসন্ধান প্রতিবেদনে বলা হয়, সিকদার গ্রুপের কর্মচারী সৈয়দ কামরুল ইসলাম ‘এস. কিউ. ট্রেডিং অ্যান্ড ডেভেলপার’ নামে একটি প্রতিষ্ঠান খুলে ২০১৯ সালের ৬ জানুয়ারি ফার্স্ট সিকিউরিটি ইসলামী ব্যাংকের কারওয়ান বাজার শাখায় একটি ‘আল-ওয়াদিয়াহ’ হিসাব খোলেন। পরিচয়দানকারী ছিলেন সিকদার গ্রুপের চেয়ারম্যান জয়নুল হক সিকদারের নাতি ও ন্যাশনাল ব্যাংকের সাবেক পরিচালক রন হক সিকদারের ছেলে জন হক সিকদার।
এর পরদিন ৭ জানুয়ারি সিকদার পরিবারের প্রতিষ্ঠান পাওয়ার প্যাক হোল্ডিংস লিমিটেডের একটি ওয়ার্ক অর্ডারের বিপরীতে এস. কিউ ট্রেডিং অ্যান্ড ডেভেলপারকে ১১০ কোটি ২৭ লাখ টাকা বিনিয়োগ সীমার ঋণের জন্য আবেদন করা হয়। হিসাব খোলার পরদিনই ঋণ আবেদন করা হয় এবং নবীন গ্রাহক হওয়ার পরও তড়িঘড়ি করে ঋণ আবেদন অনুমোদন করে তা দেওয়ার প্রক্রিয়া শুরু হয়।
দুদক অনুসন্ধানে দেখেছে, ২০১৯ সালের ২৭ জানুয়ারি ব্যাংকের ২০৫তম পরিচালনা পর্ষদ সভায় কোনো জামানত ছাড়াই, প্রকল্প পরিদর্শন প্রতিবেদন, আইনজীবী ও অডিটরের মতামত ছাড়াই ঋণ অনুমোদন করা হয়। পরে ৫ ফেব্রুয়ারি ১১টি ‘ইন্সট্রুমেন্টের’ মাধ্যমে ১১০ কোটি ২৭ লাখ টাকা এস. কিউ. ট্রেডিং অ্যান্ড ডেভেলপারের হিসাবে জমা হয়।
একই দিনে ওই অর্থ থেকে তিনটি প্রতিষ্ঠানের অনুকূলে–এম. এস. কনস্ট্রাকশন অ্যান্ড ডেভেলপারসকে ৪৭ কোটি ২৭ লাখ টাকা, মাহবুব এন্টারপ্রাইজকে ৩১ কোটি টাকা এবং ম্যাম ইমপেক্সকে ৩২ কোটি টাকা ন্যাশনাল ব্যাংকে স্থানান্তর করা হয়। পরে এই অর্থ চেকের মাধ্যমে উত্তোলন করে সিকদার পরিবার-সংশ্লিষ্ট বিভিন্ন হিসাবে ফেরত পাঠানো হয় বলে অনুসন্ধান প্রতিবেদনে বলা হয়।
দুদক বলছে, “এতে করে প্রতারণা, জাল-জালিয়াতি, ক্ষমতার অপব্যবহার ও অপরাধজনক বিশ্বাসভঙ্গের মাধ্যমে ঋণ আত্মসাৎ করে ফার্স্ট সিকিউরিটি ইসলামী ব্যাংক পিএলসিকে বিপুল ক্ষতির মুখে ফেলা হয়েছে। গত ৩০ জুন পর্যন্ত সুদসহ বকেয়া দাঁড়ায় ২০৭ কোটি ৪২ লাখ ২২ হাজার ৭৬৯ টাকা।