আর্থিক অনিয়ম, দুর্নীতি ও ঠিকাদারদের প্রাণনাশের হুমকিসহ বিআইডব্লিউটিএর প্রধান প্রকৌশলী (ড্রেজিং) রকিবুল ইসলাম তালুকদারের বিরুদ্ধে একগুচ্ছ অভিযোগ পাওয়া গেছে। সম্প্রতি নৌপরিবহন মন্ত্রণালয়ের সিনিয়র সচিব বরাবর ওইসব অভিযোগ দাখিল করা হয়। আওয়ামী আমলের সুবিধাভোগী প্রভাবশালী ওই প্রকৌশলীর বিরুদ্ধে এর আগেও প্রধান উপদেষ্টার কার্যালয় ও দুর্নীতি দমন কমিশনে লিখিত অভিযোগ দেয়া হয়।
নৌপরিবহন মন্ত্রণালয়ের একজন নিয়মিত ঠিকাদার খন্দকার হেদায়েত ইসলাম। তার ঠিকাদারি প্রতিষ্ঠানের নাম ইরেকটর্স। বিআইডব্লিউটিএর একটি দরপত্রের অনিয়ম নিয়ে নৌপরিবহন মন্ত্রণালয়ে ওই প্রতিষ্ঠানের পক্ষ থেকে গত ২১ এপ্রিল অভিযোগ করা হয়। এরপরই অভিযোগ তুলে নিতে প্রাণনাশের হুমকি ধমকি দেয়ার অভিযোগ উঠেছে রকিবুল ইসলাম তালুকদারের বিরুদ্ধে। হুমকির পরিপ্রেক্ষিতে গত ২২ এপ্রিল তেজগাঁও থানায় একটি সাধারণ ডায়েরিও করেন ওই ঠিকাদার। অভিযোগকারী হেদায়েতুল ইসলাম খন্দকার নয়া দিগন্তকে বলেন, আমি নিয়ম মেনেই মন্ত্রণালয়ে অভিযোগ করেছিলাম। কিন্তু অভিযোগ তুলে নিতে আমাকে প্রাণনাশের হুমকি দেয়া হয়। আমার বাসায় লোক পাঠিয়ে মব সৃষ্টির হুমকি দেয়া হয়েছে। জুলাই বিপ্লব পরবর্তী বাংলাদেশেও এসব দেখতে হচ্ছে। তিনি আরো বলেন, যারা আওয়ামী আমলে সুবিধাভোগী ছিল তারা এখন রাতারাতি ভোল্ট পাল্টে এখনো দাপট দেখাচ্ছে, অন্যদের দেখে নেয়ার হুমকি দিচ্ছে। উনি সরকারি কর্মচারী হয়ে কিভাবে আমাকে হুমকি দিতে পারেন- আমি এর বিচার চাই।
এর আগে ২০১৫ সালের ১৬ অক্টোবর মেসার্স ভূঁইয়া এন্টারপ্রাইজ লিমিটেডের স্বত্বাধিকারী মো: নজরুল ইসলাম ক্ষমতার অপব্যবহার, স্বজনপ্রীতি, সীমাহীন দুর্নীতি এবং অভিনব কায়দায় তৎকালীন সরকারের ভাবমূর্তি নষ্ট করার পাঁয়তারার বিরুদ্ধে রকিবুল ইসলাম তালুকদারের বিরুদ্ধে প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা গ্রহণের জন্য মন্ত্রণালয়ে অভিযোগ করেন। ওই সময় রকিবুল ইসলাম বিআইডব্লিউটিএর তত্ত্বাবধায়ক প্রকৌশলী হিসেবে কর্মরত ছিলেন। ওই অভিযোগের পরিপ্রেক্ষিতে ওই বছরের ২৩ নভেম্বর একজন দায়িত্বশীল কর্মকর্তা দ্বারা তদন্তপূর্বক এক মাসের মধ্যে তদন্ত প্রতিবেদন দেয়ার নির্দেশ দেয় মন্ত্রণালয়- সেটা আর আলোর মুখ দেখেনি।
সাম্প্রতিক মন্ত্রণালয় ও দুর্নীতি দমন কমিশনে দেয়া অভিযোগে বলা হয়েছে, ১৯৯৪ সালে সহকারী প্রকৌশলী হিসেবে বিআইডব্লিউটিএতে চাকরি শুরু করেন রকিবুল ইসলাম তালুকদার। ধাপে ধাপে তিনি ক্ষমতার অপব্যবহার ও আর্থিক কেলেঙ্কারিতে জড়িয়ে পড়েন। আওয়ামী লীগের আমলে প্রভাবশালী মন্ত্রী-এমপিদের সাথে সখ্যতা গড়ে তুলে তার প্রভাব আরো বৃদ্ধি করতে সক্ষম হয়। তিনি একজন সিভিল ইঞ্জিনিয়ার হয়েও ড্রেজিংয়ের প্রধান পদে নিয়োগ বাগিয়ে নেন তিনি। ক্ষমতার প্রভাবেই প্রধান প্রকৌশলী (ড্রেজিং) রকিবুল ইসলাম তালুকদার ঘুষ, দুর্নীতি আর বিভিন্ন প্রকল্পের কমিশনের মাধ্যমে অবৈধ সম্পদের পাহাড় গড়েছেন। অভিযোগ সূত্রে জানা গেছে, ঢাকার রাজউক পূর্বাচলে ৭.৫ কাঠার দু’টি প্লট, গাজীপুরে পাঁচ একর শালবাগান, বসুন্ধরা আবাসিক এলাকায় তিনটি প্লট, টঙ্গী এলাকায় ১০ কাঠার জমি, টাঙ্গাইলে স্থায়ী ঠিকানায় ছয়তলাবিশিষ্ট তিনটি আলিশান বাড়ি, ১০ একর জমির শালবাগান, ১৫৭ আইডিয়াল হোমস, ঢাকার শান্তিনগর-পল্টন এলাকায় ৩৭০০ বর্গফুটের চারটি ফ্ল্যাট, ঢাকা-মাওয়া হাইওয়ের পাশে আমিন মোহাম্মদ হাউজিং, প্রিয়াঙ্কা সিটিতে চারটি প্লটসহ গুলশান, বনানী, সিদ্ধেশ্বরী এলাকায় রয়েছে বেশ কয়েকটি আলিশান ফ্ল্যাট। এগুলো তিনি নামে-বেনামে নিকট আত্মীয়দের নামে কিনেছেন। এ ছাড়াও শেয়ার বাজারে বিনিয়োগ রয়েছে সাত কোটি টাকা। তিনি সরকারি অর্থ অপচয় করে একাধিকবার এশিয়া, ইউরোপ, আমেরিকা ভ্রমণ করে হুন্ডির মাধ্যমে শত শত কোটি কোটি টাকা বিদেশে পাচার করেছেন। প্রকৌশলী রকিবুল ইসলাম তালুকদার ১০ বছর ধরে ড্রেজিং বিভাগে কর্মরত। এ সময়ে তিনি ড্রেজিং বিভাগের ৩৫টি ড্রেজারসহ ২০০টি বিভিন্ন ধরনের সহযোগী জাহাজ, জলযান মেরামত, তেল চুরি, ড্রেজিং ঠিকমতো না করে ভুয়া বিল প্রস্তত করা, টেন্ডার শিডিউল অনুযায়ী নেদারল্যান্ডস, আইএইচসি, আমেরিকার ড্যামেন কোম্পানির ড্রেজার মেশিন ক্রয় না করে দেশীয় যন্ত্রপাতি সংযোজনের মাধ্যমে শত শত কোটি টাকা আত্মসাৎ করেছেন। অভিযোগ রয়েছে, বিআইডব্লিউটিএর নিজস্ব হাইড্রোগ্রাফি বিভাগ থাকলেও কোটি কোটি টাকা অপচয় করে বেসরকারি কনসালট্যান্ট নিয়োগ দিয়ে ড্রেজিংয়ের জরিপ করানো হয়। এদিকে সামান্য কিছু ড্রেজিং করা হলেও কাগজে-কলমে দেখানো হয় ৬০ থেকে ৭০ ভাগ বেশি কাজ হয়েছে। বেসরকারি পরামর্শক প্রতিষ্ঠানের মাধ্যমে প্রকল্প পরিচালক রকিবুল ইসলাম তালুকদার তার ইচ্ছে অনুযায়ী মাটির পরিমাণ বৃদ্ধি করে শত কোটি টাকা লুটপাট করেছেন। তার বিরুদ্ধে তদন্ত কমিটি গঠন করা হলেও ক্ষমতার অপব্যবহার করে তদন্ত কাজে বাধা দেয়ায় সে তদন্তটি এখনো আলোর মুখ দেখেনি।
এসব অনিয়ম ও দুর্নীতির বিষয় ক্ষতিয়ে দেখার জন্য দুদক তার বিরুদ্ধে গত বছরের ফেব্রুয়ারি মাসে অনুসন্ধানের জন্য একটি চিঠি স্বাক্ষর করে। ওই চিঠিতে বলা হয়, “প্রাপ্ত তথ্যের ভিত্তিতে অনুসন্ধান করিয়া দুর্নীতি দমন কমিশন স্থির বিশ্বাস জন্মাইয়াছে যে, বিআইডব্লিটিএর প্রধান প্রকৌশলী (ড্রেজিং) রকিবুল ইসলাম তালুকদার জ্ঞাত আয়বহির্ভূত স্বনামে/বেনামে বিপুল পরিমাণ সম্পদ/সম্পত্তির মালিক হইয়াছেন।” এতে আরো বলা হয়, প্রকৌশলী রকিবুল ইসলাম তালুকদার, তার স্ত্রী-সন্তান এবং তার ওপর নির্ভরশীল পরিবার এবং ব্যক্তিদের স্থাবর-অস্থাবর সম্পদের হিসাব নির্দিষ্ট ছক অনুযায়ী দাখিলের জন্য নির্দেশ দেয়া হয়। সংশ্লিষ্ট সূত্র বলছে, ক্ষমতাচ্যুত আওয়ামী সরকারের ঘনিষ্ঠ সহযোগী হওয়ায় ক্ষমতার প্রভাব খাটিয়ে নির্ধারিত সময়ে সম্পদের হিসাব দাখিল তিনি করেননি। পরবর্তীতে কাটছাঁট করে সম্পদের হিসেব আংশিক দাখিল করেন। এ দিকে গত ৫ আগস্ট ছাত্র-জনতার গণ-অভ্যুত্থানে আওয়ামী লীগ সরকারের পতনের পর রাতারাতি রকিবুল ইসলাম তালুকদার ভোল পাল্টিয়ে অন্তর্বর্তী সরকারের সাথে মিশে বহাল তবিয়তে রয়েছেন।
বিআইডব্লিটিএর প্রধান প্রকৌশলী (ড্রেজিং) রকিবুল ইসলাম তালুকদারের এসব অনিয়ম, দুর্নীতিসহ সব অভিযোগের বিষয়ে বক্তব্য নেয়ার জন্য তার ব্যক্তিগত মোবাইল নম্বরে এ প্রতিবেদক একাধিকবার কল দেন। মোবাইল নম্বর বন্ধ থাকায় তার বিরুদ্ধে অভিযোগের বিষয়ে বক্তব্য নেয়া সম্ভব হয়নি।