বাংলাদেশ এখন এশিয়ার শীর্ষে ঋণখেলাপিতে। সম্প্রতি এশীয় উন্নয়ন ব্যাংক (এডিবি) প্রকাশিত এক প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, ঋণখেলাপির হারে বাংলাদেশ এখন এশিয়ার সব দেশকে ছাড়িয়ে গেছে। দেশের ব্যাংকিং খাতে খেলাপি ঋণের পরিমাণ ক্রমাগত বাড়ছে এবং এটি অর্থনীতির জন্য বড় ঝুঁকি তৈরি করছে।
কী বলছে এডিবির প্রতিবেদন
এডিবির সাম্প্রতিক প্রতিবেদন অনুযায়ী, বাংলাদেশের ব্যাংকিং খাতে খেলাপি ঋণের পরিমাণ মোট ঋণের প্রায় ১০ শতাংশেরও বেশি। এটি দক্ষিণ এশিয়ার গড় হার থেকে দ্বিগুণ। প্রতিবেদনটিতে উল্লেখ করা হয়েছে, খেলাপি ঋণ ব্যাংকগুলোর তারল্য সংকট বাড়িয়ে দিচ্ছে, বিনিয়োগের পরিবেশ ক্ষতিগ্রস্ত করছে এবং সার্বিক অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধিকে বাধাগ্রস্ত করছে।
এডিবির এশিয়া অ্যান্ড প্যাসিফিক ইকোনমিক আপডেট প্রতিবেদনে বলা হয়েছে,“খেলাপি ঋণ নিয়ন্ত্রণে আনতে না পারলে ব্যাংকিং খাত ঝুঁকিতে পড়বে এবং দেশের জিডিপি প্রবৃদ্ধি টেকসই রাখা কঠিন হবে।”
বর্তমান অবস্থা
বাংলাদেশ ব্যাংকের সর্বশেষ তথ্য অনুযায়ী, ২০২৫ সালের জুন শেষে দেশের ব্যাংকিং খাতে মোট খেলাপি ঋণের পরিমাণ দাঁড়িয়েছে প্রায় ১.৭৫ লাখ কোটি টাকা। এর মধ্যে রাষ্ট্রায়ত্ত ব্যাংকগুলোতে খেলাপি ঋণ সবচেয়ে বেশি। অনেক বেসরকারি ব্যাংকেও খেলাপি ঋণের হার ক্রমাগত বাড়ছে।
বিশেষজ্ঞরা বলছেন, এই খেলাপি ঋণের বড় অংশই বড় করপোরেট গ্রাহকদের। সাধারণ কৃষি বা ক্ষুদ্র উদ্যোক্তার খেলাপি ঋণের হার তুলনামূলকভাবে কম।
কেন বাড়ছে খেলাপি ঋণ
অর্থনীতিবিদদের মতে, খেলাপি ঋণ বাড়ার প্রধান কারণ হলো— ঋণ আদায়ে শিথিল নীতি, রাজনৈতিক প্রভাব খাটিয়ে ঋণ মওকুফ বা পুনঃতফসিল, ব্যাংক ব্যবস্থাপনায় দুর্বলতা ও দুর্নীতি, অর্থনীতিতে মন্দা ও ব্যবসায়িক ঝুঁকি বৃদ্ধি ইত্যাদি।
ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের অর্থনীতি বিভাগের অধ্যাপক ড. সেলিনা আখতার বলেন,“যতদিন পর্যন্ত রাজনৈতিক বিবেচনায় ঋণ বিতরণ ও পুনঃতফসিল চলবে, ততদিন খেলাপি ঋণ কমানো সম্ভব নয়। ব্যাংক খাতকে রাজনৈতিক প্রভাবমুক্ত করে স্বচ্ছ ব্যবস্থাপনা নিশ্চিত করতে হবে।”
অর্থনীতিতে প্রভাব
খেলাপি ঋণের এই ঊর্ধ্বগতি দেশের অর্থনীতিতে নানা নেতিবাচক প্রভাব ফেলছে। ব্যাংকগুলোর তারল্য সংকট বাড়ছে, ফলে নতুন ঋণ বিতরণ কমে যাচ্ছে। শিল্প ও উৎপাদন খাত নতুন বিনিয়োগ পাচ্ছে না, ফলে কর্মসংস্থান তৈরি ব্যাহত হচ্ছে। আমানতকারীদের আস্থা কমে যাচ্ছে, ব্যাংকে জমা রাখার প্রবণতা হ্রাস পাচ্ছে। বৈদেশিক বিনিয়োগকারীরাও উদ্বিগ্ন হয়ে পড়ছে।
অর্থনীতিবিদ ড. আব্দুল হক বলেন,“খেলাপি ঋণ দেশের অর্থনীতির জন্য ‘সাইলেন্ট কিলার’। এটি বিনিয়োগ, কর্মসংস্থান ও প্রবৃদ্ধি—সবকিছুর উপর নেতিবাচক প্রভাব ফেলছে।”
সরকারের পদক্ষেপ
সরকার খেলাপি ঋণ কমাতে বিভিন্ন পদক্ষেপ নিয়েছে। বাংলাদেশ ব্যাংক পুনঃতফসিল নীতি সংস্কার করেছে, কঠোর ঋণ শ্রেণীকরণ প্রক্রিয়া চালু করেছে এবং বিশেষ খেলাপি ঋণ আদায় ট্রাইব্যুনাল সক্রিয় করেছে। এছাড়া ডিজিটাল ঋণ মনিটরিং সিস্টেম চালুর কাজ চলছে।
অর্থ মন্ত্রণালয়ের এক কর্মকর্তা বলেন,“আমরা খেলাপি ঋণ নিয়ন্ত্রণে আনতে বহুমুখী উদ্যোগ নিয়েছি। তবে এটি রাতারাতি কমানো সম্ভব নয়। দীর্ঘমেয়াদী সংস্কার দরকার।”
সমাধানের পথ
অর্থনীতিবিদরা বলছেন, খেলাপি ঋণ নিয়ন্ত্রণে আনতে হলে
১. আইনগত ব্যবস্থা কঠোর করতে হবে – ঋণ আদায় প্রক্রিয়া দ্রুত করতে বিশেষ আদালত গঠন ও কার্যকর করতে হবে।
২. রাজনৈতিক প্রভাব বন্ধ করতে হবে – ঋণ বিতরণে স্বচ্ছতা ও যোগ্যতার ভিত্তিতে সিদ্ধান্ত নিতে হবে।
৩. দুর্নীতি দমন করতে হবে – ব্যাংক কর্মকর্তাদের জবাবদিহি বাড়াতে হবে।
৪. বড় খেলাপিদের বিরুদ্ধে উদাহরণ তৈরি করতে হবে – বড় ঋণখেলাপিদের সম্পদ বাজেয়াপ্ত করে আদায় করতে হবে।
৫. বেসেল-৩ মানদণ্ড কার্যকর করতে হবে – ব্যাংকের ঝুঁকি ব্যবস্থাপনা আন্তর্জাতিক মানে উন্নীত করতে হবে।
সাধারণ আমানতকারীরা বলছেন, তারা চান ব্যাংক খাত হোক নিরাপদ ও স্বচ্ছ। গার্মেন্টস ব্যবসায়ী সোহেল রানা বলেন,“আমরা পরিশ্রম করে টাকা জমা রাখি। সেই টাকায় যদি কয়েকজন বড় খেলাপির সুবিধা হয় আর আমরা ক্ষতিগ্রস্ত হই, সেটা মেনে নেওয়া যায় না।”
উল্লেখ্য, এশিয়ার শীর্ষে ঋণখেলাপি হওয়া বাংলাদেশের জন্য উদ্বেগজনক। এই প্রবণতা যদি নিয়ন্ত্রণে আনা না যায়, তবে ব্যাংক খাতের স্থিতিশীলতা এবং দেশের অর্থনীতি বড় ঝুঁকিতে পড়বে। সরকারের নেওয়া পদক্ষেপগুলো দ্রুত বাস্তবায়ন করা এবং বড় ঋণখেলাপিদের বিরুদ্ধে কঠোর ব্যবস্থা নেওয়া এখন সময়ের দাবি।