গত অর্থবছরে বিভিন্ন বন্দর দিয়ে মিথ্যা ঘোষণায় আমদানি করা প্রায় ৩ হাজার ৭৯৫ কোটি টাকার পণ্য আটক করেছে জাতীয় রাজস্ব বোর্ড (এনবিআর)। আটক পণ্যের বেশির ভাগই ছিল মাদকদ্রব্য। কাগজে কলমে এসব পণ্যের দাম দেখানো হয়েছিল ৯৫১ কোটি টাকা। ব্যাংকিং চ্যানেলের মাধ্যমে এ অর্থ পাচার করা হয়েছে। এনবিআরের একটি প্রতিবেদন থেকে এসব তথ্য জানা যায়।
প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, মিথ্যা ঘোষণায় মাদকদ্রব্য ছাড়াও যৌন উত্তেজক পণ্য, সোনার বার, তৈরি পোশাক শিল্পের কাঁচামাল, উচ্চ মূল্যের ওষুধ, ইলেকট্রনিকস পণ্য, দামি মোবাইল ফোন, উচ্চ সিসির মোটরসাইকেল, বিলাসবহুল গাড়িও আমদানি করা হয়েছে। জরুরি ওষুধ, চিকিৎসা সামগ্রী, শিল্পের কাঁচামালসহ বিভিন্ন প্রয়োজনীয় পণ্য আমদানির কথা বলে এসব আনা হয়েছে। চট্টগ্রাম বন্দর দিয়ে মিথ্যা ঘোষণায় আমদানির সময় সবচেয়ে বেশি পণ্য আটক করা হয়েছে। মিথ্যা ঘোষণায় মালয়েশিয়া, চীন ও ভারত থেকে আমদানির সময় এবং দুবাইতে রপ্তানির সময় বেশি পণ্য আটক করা হয়। তবে অস্ট্রেলিয়া, মালয়েশিয়া, সিঙ্গাপুর ও চীন থেকে মিথ্যা ঘোষণায় আমদানি করা পণ্যের মধ্যে মাদকদ্রব্য বেশি পাওয়া গিয়েছে।
প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, মিথ্যা ঘোষণায় মাদকদ্রব্য এনে রাজধানীসহ সারা দেশে বিক্রি করা হয়েছে। বয়সে তরুণ-তরুণীরা মাদকের প্রধান ক্রেতা। স্কুল, কলেজ ও বিশ্ববিদ্যালয়ের আশেপাশের বিভিন্ন দোকানের মাধ্যমে এসব বিক্রি করা হয়। আবার মিথ্যা তথ্য দিয়ে আমদানি করা মাদকদ্রব্য মিথ্যা তথ্য দিয়ে অন্যদেশেও রপ্তানি করা হয়েছে। আটক মাদকদ্রব্যের মধ্যে আইস, ইয়াবা, মদ, ফেনসিডিল, হেরোইন বেশি। কোকেন ও বিভিন্ন ধরনের ইনজেকশনও আটক করা হয়েছে। মরফিন, ভায়াগ্রা, সানাগ্রাও আটক করা হয়েছে।
প্রতিবেদন থেকে জানা যায়, জানুয়ারিতে মালয়েশিয়া থেকে চট্টগ্রাম বন্দরে সুজাতা এক্সেসরিজ লিমিটেডের নামে আমদানি করা কাঁচামাল পৌঁছায়। বন্দরের কর্মকর্তারা কাগজপত্রের সঙ্গে কার্টনের ভেতরে কী আছে তা মিলিয়ে দেখতে গিয়ে দেখেন কাঁচামালের সঙ্গে গোপনে ৭শ গ্রাম ক্রিস্টাল মেথ (আইস) আনা হয়েছে। এর বাজার মূল্য ৭০ থেকে ৮০ লাখ টাকা। শুল্ক শাখার কর্মকর্তারা মালামাল আটক করেন। তদন্তে বেরিয়ে আসে, ওই নামে বাস্তবে কোনো কারখানার অস্তিত্বই নেই। জাল কাগজপত্র ব্যবহার করে এলসি খোলা হয়েছিল। চট্টগ্রাম বন্দর দিয়ে মিথ্যা ঘোষণায় আমদানির সময় মাদকদ্রব্য কোকেন আটক করা হয়েছে। বেনাপোল বন্দর দিয়ে মিথ্যা ঘোষণায় বিভিন্ন ধরনের যৌন উত্তেজক পণ্য আটক করা হয়েছে। বিমানবন্দর দিয়ে আমদানির সময় বিভিন্ন ধরনের মাদক আটক করা হয়েছে। এসব চালানের প্রতিটি ভুয়া প্রতিষ্ঠানের নামে আনা হয়েছে। এসব ভুয়া প্রতিষ্ঠানের মধ্যে হাসপাতাল, ক্লিনিক ও তৈরি পোশাক খাতের প্রতিষ্ঠানের নাম বেশি।
প্রতিবেদন থেকে আরও জানা যায়, বিগত সরকারের গত ১৫/১৬ বছর ব্যবসায়ী নামধারী কিছু প্রভাবশালী ব্যক্তি আমদানি-রপ্তানির আড়ালে মিথ্যা তথ্য দিয়ে হাজার হাজার কোটি টাকা হাতিয়ে নিয়েছে। ব্যাংক ও এনবিআরের অসাধু কর্মকর্তা-কর্মচারীদের সহযোগিতা ছাড়া এ কাজ করা সম্ভব হয়নি। এসব ব্যক্তি ব্যাংক ও এনবিআরের অসাধু কর্মকর্তা-কর্মচারীদের অনৈতিক সুবিধা দিয়ে নিরাপদে এ কাজ করেছেন।
প্রতিবেদনে দেখা যায়, বিগত সরকারের সময়ের নামি ব্যবসায়ীদের অনেকে মিথ্যা ঘোষণায় আমদানি-রপ্তানিতে জড়িত ছিলেন বলে প্রাথমিক প্রমাণ পাওয়া গিয়েছে। এদের অনেকে বিভিন্ন ব্যবসায়ী সংগঠনের নেতা হিসেবেও দীর্ঘদিন দাপটের সঙ্গে ব্যবসা করেছেন। সাবেক প্রধানমন্ত্রীর উপদেষ্টা সালমান এফ রহমান, সাবেক বাণিজ্যমন্ত্রী টিপু মুনশী, সাবেক স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী আসাদুজ্জামান খান কামালের মতো লোকেরাও জড়িত ছিলেন বলে প্রমাণ পাওয়া গিয়েছে। এ ছাড়া শেখ হাসিনা পরিবারের দাপুটে সদস্যরাও এ কাজে জড়িত ছিলেন বলে নিশ্চিত হওয়া গেছে। বর্তমান এনবিআরের অনেক কর্মকর্তা-কর্মচারী মিথ্যা ঘোষণায় জড়িত আছে কি না তার তদন্ত চলছে। এরই মধ্যে এনবিআর সংশ্লিষ্টদের অনেকের বিষয়ে সরকারের অন্য প্রতিষ্ঠান থেকেও তদন্ত করে দেখা হচ্ছে। ছাত্র-জনতার অভ্যুত্থানের পর এসব ব্যক্তিদের অনেকে আত্মগোপনে গেলে বা গ্রেপ্তার হলেও তাদের দলের লোকজন মিথ্যা ঘোষণায় আমদানি-রপ্তানি করতে থাকেন। আগের মতোই ব্যাংক ও এনবিআরের কিছু অসাধু কর্মকর্তা-কর্মচারীরা অনৈতিক সুবিধার বিনিময়ে সহযোগিতা করতে থাকেন।
এনবিআর চেয়ারম্যান আবদুর রহমান দায়িত্ব গ্রহণের পর মিথ্যা ঘোষণায় আমদানি-রপ্তানি বন্ধে জিরো-টলারেন্স নীতি গ্রহণ করেন। মিথ্যা ঘোষণায় পণ্য আমদানি-রপ্তানি বন্ধে এনবিআর চেয়ারম্যান শুল্ক শাখার দক্ষ ও সৎ কর্মকর্তা-কর্মচারীদের নিয়ে টাস্কফোর্স কমিটি গঠন করে দেন। টাস্কফোর্স কমিটির সদস্য হিসেবে শুল্ক গোয়েন্দা ও তদন্ত অধিদপ্তরের কর্মকর্তা-কর্মচারীদের বেশি রাখা হয়।
টাস্কফোর্স কমিটি গুরুত্ব দিয়ে কাজ করতে থাকে। কোন বন্দর দিয়ে মিথ্যা ঘোষণায় কী ধরনের পণ্য বেশি আসছে, এ কাজে কে বা কারা জড়িত, মিথ্যা ঘোষণায় পণ্য আমদানি-রপ্তানিতে সরকার কী পরিমাণ রাজস্ব বঞ্চিত হচ্ছে, কোন ব্যাংকের মাধ্যমে এলসি বা ঋণপত্র খুলে মিথ্যা ঘোষণায় পণ্য বেশি আমদানি-রপ্তানি হচ্ছে, ব্যাংক ও এনবিআরের কে বা কারা এ কাজে জড়িত- এমন অনেক বিষয় খতিয়ে দেখে তদন্ত করে টাস্কফোর্স কমিটি প্রতিবেদন প্রণয়ন করে। টাস্কফোর্স কমিটি তদন্তের প্রয়োজনে সিআইডিসহ সরকারের অন্যান্য প্রতিষ্ঠান থেকেও তথ্য সংগ্রহ করেছে।
এনবিআর চেয়াম্যান আবদুর রহমান খান বলেন, মিথ্যা ঘোষণায় পণ্য আমদানি-রপ্তানি বন্ধে এনবিআর অতীতের যেকোনো সময়ের চেয়ে জোর দিয়ে কাজ করছে। এ অসাধু ব্যক্তিরা যত বড় প্রভাবশালীই হোক না কেন এনবিআর জিরো টলারেন্স নীতি গ্রহণ করেছে। আশা করি এনবিআরের এমন অবস্থানের কারণে মিথ্যা ঘোষণায় আমদানি-রপ্তানি কমবে।
তিনি আরও বলেন, এনবিআরের সব কাজে এখন প্রযুক্তির ব্যবহার বাধ্যতামূলক করা হচ্ছে।
টাস্কফোর্স কমিটির প্রতিবেদন থেকে জানা যায়, তৈরি পোশাক খাতের কারখানাগুলো শতভাগ রপ্তানিমুখী প্রতিষ্ঠান হিসেবে কাঁচামাল আমদানিতে শুল্কমুক্ত সুবিধা পেয়ে থাকে। এসব সুবিধা পাওয়ার শর্ত থাকে রপ্তানির জন্য পণ্য উৎপাদনে ঠিক যতটা কাঁচামাল লাগবে ততটাই আমদানি করবে। কিন্তু কিছু অসাধু ব্যক্তি তৈরি পোশাক শিল্পের বিভিন্ন প্রতিষ্ঠানের নামে কম দামের ও কম পরিমাণের কাঁচামাল (ফেব্রিক বা কাপড় (সুতি, লিনেন, সিল্ক, উল, নাইলন, পলিয়েস্টার ইত্যাদি), সুতা, বিভিন্ন ধরনের এক্সেসরিজ আমদানির কথা বলে বেশি দামের বেশি পরিমাণের পণ্য শুল্ক না দিয়ে এনে কারখানায় না লাগিয়ে খোলা বাজারে বিক্রি করে দিয়েছেন। বেশিরভাগই জাল কাগজপত্র ব্যবহার করে বিভিন্ন প্রতিষ্ঠানের নামে এ কাজ করেছেন। এসব কাঁচামাল দিয়ে উন্নতমানের পণ্য রপ্তানি করা হবে বলে ঘোষণা দিলেও রপ্তানি করেছে নিম্নমানের কিছু পণ্য।
রপ্তানি করা পণ্যের দাম হিসেবে একটি অর্থও দেশে আনেনি। বিদেশেই আছে।
এনবিআর সাবেক চেয়ারম্যান ড. মো. আবদুল মজিদ বলেন, ‘মিথ্যা ঘোষণায় আমদানি-রপ্তানি বন্ধে এনবিআর আগের চেয়ে তৎপর। তবে সম্পূর্ণ প্রযুক্তি ব্যবহারে কাজ করতে সক্ষম হলে মিথ্যা ঘোষণায় আমদানি রপ্তানি কমবে। অর্থপাচারও কমবে।