নিরাপত্তা ও রাজনৈতিক সূত্রগুলোর বরাতে জানা যায়, মেজর জেনারেল (অব.) হামিদুল হকের সঙ্গে শুধু সামরিক বাহিনীর অভ্যন্তরেই নয়, বরং রাজনৈতিক মহলেও সক্রিয় যোগাযোগ ছিল। ডিজিএফআইয়ের মহাপরিচালক থাকার সুবাদেই এ যোগাযোগ গড়ে ওঠে। বিশেষ করে জামায়াতে ইসলামীর একটি অংশের সঙ্গে তার ঘনিষ্ঠ যোগাযোগ ছিল এমন দাবিও করেছে সংশ্লিষ্ট একটি সূত্র
২০২২ সালের নভেম্বর থেকে ২০২৪ সালের ১২ আগস্ট পর্যন্ত সশস্ত্র বাহিনীর সামরিক গোয়েন্দা ইউনিট ডিরেক্টরেট জেনারেল অব ফোর্সেস ইন্টেলিজেন্সের মহাপরিচালক (ডিজি) ছিলেন মেজর জেনারেল (অব.) হামিদুল হক। ডিজিএফআই থেকে সরিয়ে দেয়ার মাসখানেক পর ২০২৪ সালের ১২ সেপ্টেম্বর তাকে বাধ্যতামূলক অবসরে পাঠানো হয়। ক্ষমতা গ্রহণের পর সামরিক বাহিনী পুনর্গঠনের সূচনালগ্নে মেজর জেনারেল হামিদুল হককে ডিজিএফআইয়ে থেকে যেতে এবং রাষ্ট্র পুনর্গঠনে সহায়তা করতে অনুরোধ করেছিলেন অন্তর্বর্তী সরকারের একজন শীর্ষ ব্যক্তিত্ব।
জানা যায়, মেজর জেনারেল (অব.) হামিদুল হক আগস্টের শুরুর দিকে উত্তাল সময়ে সেনাপ্রধান জেনারেল ওয়াকার-উজ-জামানকে বিভিন্নভাবে সহায়তা করে গেছেন। এমনকি ৫ আগস্টের আগে ন্যাশনাল টেলিকমিউনিকেশন মনিটরিং সেন্টারের (এনটিএমসি) সাবেক মহাপরিচালক মেজর জেনারেল (বরখাস্ত) জিয়াউল আহসান ও স্পেশাল সিকিউরিটি ফোর্সের (এসএসএফ) সাবেক ডিজি লেফটেন্যান্ট জেনারেল (বরখাস্ত) মুজিবুর রহমান যখন সেনাপ্রধানকে উৎখাতের ষড়যন্ত্রে লিপ্ত হয়েছিলেন, তখনো মেজর জেনারেল হামিদুল হক সেনাপ্রধানকে সহায়তা করেন। এছাড়া ৫ আগস্টের আগে হাসিনাবিরোধী আন্দোলনে সাবেক যে সেনা কর্মকর্তারা সরব হয়েছিলেন তাদের সঙ্গে যোগাযোগ ছিল হামিদুল হকের।
গত ৮ জুলাই মেজর জেনারেল (অব.) হামিদুল হকের চারটি ব্যাংক অ্যাকাউন্ট জব্দ করার আদেশ দিয়েছিলেন আদালত। যদিও পরে দুদকের উপপরিচালক (জনসংযোগ) আকতারুল ইসলাম গণমাধ্যমকে বলেছেন, জব্দ হওয়া ব্যাংক হিসাবগুলো ডিজিএফআইয়ের, সংস্থাটির সাবেক মহাপরিচালক হামিদুল হকের নয়। ডিজিএফআইয়ের চারটি প্রাতিষ্ঠানিক অ্যাকাউন্ট প্রতিষ্ঠানের নামে না হয়ে ধারাবাহিকভাবে প্রতিষ্ঠানপ্রধানের নামে হওয়ায় করণিক ত্রুটির কারণে এগুলো ব্যক্তিগত ব্যাংক হিসাব হিসেবে জব্দ হয়েছে। এটি একটি তথ্যসূত্রগত ত্রুটি ছিল। তবে হামিদুল হকের বিরুদ্ধে দুদকের তদন্ত চলমান রয়েছে।
মেজর জেনারেল (অব.) হামিদুল হক ডিজিএফআইয়ের ডিজি হিসেবে ২০২২ সালের নভেম্বর থেকে ২০২৪ সালের ১২ আগস্ট পর্যন্ত দায়িত্ব পালন করেন। সূত্রমতে, তিনি সংস্থাটিকে রাজনৈতিক বিতর্কের বাইরে রাখার প্রচেষ্টাও চালিয়েছিলেন। এর আগে ২০১০ সালে হামিদুল হকের বিরুদ্ধে বিডিআর বিদ্রোহ নিয়ে গণমাধ্যম কর্মীদের তথ্য দেয়ার অভিযোগ আনা হয়েছিল। অভিযোগ ছিল তিনি বিডিআর বিদ্রোহ-সংক্রান্ত বিষয় নিয়ে মিডিয়ার সঙ্গে আলোচনা করেছেন এবং গণমাধ্যম কর্মীদের সহায়তা করেছেন। এ বিষয়ে তাকে সতর্ক করা হয়। ওই সময় তার চাকরি হারানোর ঝুঁকিও তৈরি হয়।
১৯৭০ সালে কক্সবাজারে জন্মগ্রহণ করা হামিদুল হক বাংলাদেশ সেনাবাহিনীতে যোগ দেন ১৯৮৮ সালে। প্রশিক্ষণ শেষে ১৯৯০ সালের ২২ জুন সেনাবাহিনীর ইনফ্যান্ট্রি কোরে কমিশন পান তিনি। মেজর জেনারেল (অব.) হামিদুল হক সিলেটে ১৭ পদাতিক ডিভিশনের জিওসি এবং সিলেটের এরিয়া কমান্ডার হিসেবে দায়িত্ব পালন করছিলেন। এছাড়া পদ্মা সেতুর নিরাপত্তার দায়িত্বে নিয়োজিত ৯৯ কম্পোজিট ব্রিগেড এবং পার্বত্য চট্টগ্রামে ২০৩ ইনফ্যান্ট্রি ব্রিগেডের নেতৃত্ব দিয়েছেন তিনি। এছাড়া তিনি ন্যাশনাল ডিফেন্স কলেজের কলেজ সেক্রেটারি এবং কলেজের গভর্নিং বডির সদস্য হিসেবেও দায়িত্ব পালন করেছেন।
জুলাই-আগস্টে শিক্ষার্থীদের নেতৃত্বে বিক্ষোভের সূত্র ধরে পরিস্থিতি যখন আরো খারাপের দিকে যাচ্ছিল, ওই সময় দেশজুড়ে সেনা মোতায়েন করে সরকার। ৩ আগস্ট সেনাপ্রধানের সঙ্গে একটি গুরুত্বপূর্ণ বৈঠকে তরুণ সেনা কর্মকর্তারা জনগণের ওপর গুলি নয় এ মনোভাব প্রকাশ করেছিলেন। সেনাপ্রধান জেনারেল ওয়াকার-উজ-জামানও জানিয়েছিলেন বেসামরিক নাগরিকের ওপর গুলি চালাবে না সেনাসদস্যরা।
আন্দোলনকারীদের ওপর সেনাবাহিনী গুলি না চালানোয় সেনাপ্রধান ওয়াকার-উজ-জামানের নেতৃত্ব নিয়ে অসন্তোষ ছিল এসএসএফের সাবেক ডিজি লেফটেন্যান্ট জেনারেল (বরখাস্ত) মুজিবুর রহমান এবং মেজর জেনারেল (বরখাস্ত) জিয়াউল আহসানের মধ্যে। তাদের অভিযোগ ছিল, ‘ওয়াকার নিজের কোরামকেও নিয়ন্ত্রণে রাখতে পারছেন না, আন্দোলন কীভাবে সামলাবেন’? এর পরিপ্রেক্ষিতে শেখ হাসিনার অনুমতিতে ওয়াকার-উজ-জামানকে সরিয়ে মুজিবুর রহমানকে সেনাপ্রধান করার পরিকল্পনা করা হয়। তবে একাধিক সূত্র মারফত সে খবর পেয়েছিলেন সেনাপ্রধান। তাদের মধ্যে মেজর জেনারেল (অব.) হামিদুল হক একজন ছিলেন বলে জানা যায়। সে পরিকল্পনার খবর জানার পর হামিদুল হক তাৎক্ষণিকভাবে বিষয়টি পর্যবেক্ষণ করেন এবং বিদ্যমান ভারসাম্য রক্ষায় নিজেকে দৃশ্যত নিরপেক্ষ রাখেননি, সেনাপ্রধানকে সহায়তা করে গেছেন।
নিরাপত্তা ও রাজনৈতিক সূত্রগুলোর বরাতে জানা যায়, মেজর জেনারেল (অব.) হামিদুল হকের সঙ্গে শুধু সামরিক বাহিনীর অভ্যন্তরেই নয়, বরং রাজনৈতিক মহলেও সক্রিয় যোগাযোগ ছিল। ডিজিএফআইয়ের মহাপরিচালক থাকার সুবাদেই এ যোগাযোগ গড়ে ওঠে। বিশেষ করে জামায়াতে ইসলামীর একটি অংশের সঙ্গে তার ঘনিষ্ঠ যোগাযোগ ছিল এমন দাবিও করেছে সংশ্লিষ্ট একটি সূত্র। আরেকটি সূত্র জানায়, ছাত্র-জনতার অভ্যুত্থান চলাকালে সেনাবাহিনীকে নিউট্রালাইজ রাখা বা অভ্যুত্থানের বিপক্ষে সক্রিয় না করার বিষয়েও মেজর জেনারেল (অব.) হামিদুল হকের সঙ্গে জামায়াতের একটি অংশের অনানুষ্ঠানিক যোগাযোগ ছিল। ওই সময় সেনাবাহিনীর ভেতরে নিরপেক্ষতা বজায় রাখার কৌশলের অংশ হিসেবেই এ যোগাযোগ স্থাপন করা হয়েছিল বলে দাবি করেন সংশ্লিষ্টরা। যদিও এসব বিষয়ে কখনো প্রকাশ্যে কোনো আনুষ্ঠানিক বক্তব্য পাওয়া যায়নি, তবে এটি নিয়ে অভ্যন্তরীণ মহলে নানা ধরনের আলোচনা রয়েছে।