ঢাকা ০১:১৫ অপরাহ্ন, বুধবার, ০১ অক্টোবর ২০২৫, ১৬ আশ্বিন ১৪৩২ বঙ্গাব্দ
ব্রেকিং নিউজ:
নেপথ্যে ১০ কোটি টাকার নিয়োগ বাণিজ্য: প্রাণিসম্পদ অধিদপ্তরে হাইকোর্টের আপীল বিভাগের নির্দেশনা অমান্য করে ৫৪ জন কর্মচারি নিয়োগ, আরো প্রায় ৬০০জনের নিয়োগ চুড়ান্ত!  রাজৈরের বিভিন্ন পূজা মন্ডপ পরিদর্শন করেন কৃষক দল ও পূজা উদযাপন ফ্রন্টের নেতৃবৃন্দ। ফরিদপুরের ট্রাক চাপায় এক যুবকের মর্মান্তিক মৃত্যু হয়েছে।  মৃত্যুর সাথে পাঞ্জা লড়ছেন তোফায়েল আহমেদ। জরুরি ভর্তি করা হল হাসপাতালে। বহু বছর সেনাবাহিনীর থাবায় মুখোশ উন্মোচন হলো মাদক ব্যবসায়ী কাশেম ওরফে ফেন্সি কাসেমের। শেরপুরে দলিত নারীদের মুষ্টির চালে “দুর্গা পূজা”। “গীতার আলো ঘরে ঘরে জ্বালো” এ শ্লোগানে মুখরিত মাদারীপুর। মনের মাধুরী মিশিয়ে সাজাচ্ছে দেবী দুর্গাকে।মন্ডপে মন্ডপে চলছে মা’কে বরণের প্রস্তুতি। এক রাতের রক্তগাথা: শাপলা চত্বরে নৃশংসতার ১২ বছর। বিসিআইসি: খাদ্য নিরাপত্তা ও শিল্পায়নের অগ্রগামী প্রতিষ্ঠান।

“হাসপাতালে লিফটকান্ড” গণপূর্ত নির্বাহী প্রকৌশলী হালিমের তদারকিতে সীমাহীন দুর্নীতি!

  • মোঃ শাফিন আহম্মেদ
  • আপডেট সময় : ০৮:২৬:৩৬ অপরাহ্ন, বুধবার, ১০ সেপ্টেম্বর ২০২৫
  • ৩৮০ জন সংবাদটি পড়েছেন

গৃহায়ণ ও গণপূর্ত মন্ত্রণালয়ের অধীনে গণপূর্ত অধিদপ্তর বিভিন্ন রাষ্ট্রীয় গুরুত্বপূর্ণ স্থাপনা নির্মাণ ও তার সংস্কার কাজের সাথে সম্পৃক্ত রয়েছে। গুরুত্বপূর্ণ এই মন্ত্রণালয়টির উপর নজরদারী ও ক্ষমতার ভাগ বসাতে দেশের ক্ষমতাশীলরা সর্বদাই তৎপর থাকে। এই মন্ত্রণালয় ঘিরে অবকাঠামো নির্মাণ ও উন্নয়নে প্রতি বছর হাজার হাজার কোটি টাকার কাজ সম্পাদন হয়। আর এ কারণেই এই মন্ত্রণালয়টি অন্যান্য মন্ত্রণালয় থেকে বেশী গুরুত্বপূর্ণ বিশেষ করে ঠিকাদার ও ব্যবসায়ীদের নিকট। গণপূর্ত অধিদপ্তর থেকে সুযোগ সুবিধা গ্রহন করে এর সাথে সম্পৃক্ত ঠিকাদার ও কিছু দুর্নীতি পরায়ণ প্রকৌশলী শত শত কোটি টাকার মালিক বনে গেছে। এই কার্যক্রম অতীতেও ছিলো এবং বর্তমানেও চলমান আছে। একটি শক্তিশালী সিন্ডিকেট প্রত্যক্ষ ও পরোক্ষভাবে সহযোগিতা করার ক্ষেত্রে মন্ত্রণালয় ও অধিদপ্তরের মূল ভুমিকার কর্তারা জড়িত। কর্তাদের পুজি করেই কিছু প্রকৌশলী হয়ে উঠেছে বেপরোয়া। তার মধ্যে অন্যতম ঢাকা গণপূর্ত ই/এম বিভাগ-১০ এর নির্বাহী প্রকৌশলী আব্দুল হালিম। অভিযোগ রয়েছে, কমিশনের বিনিময়ে কাজ প্রদান, উন্নয়ন কাজ না করেই সরকারি বরাদ্দের কোটি কোটি টাকা তুলে নিয়ে ঠিকাদারের সাথে ভাগাভাগি, চাকুরী জীবনে অসততার আশ্রয় নিয়ে অঢেল ধন সম্পদের মালিক এবং গাজীপুরের শহীদ তাজউদ্দীন আহমদ মেডিক্যাল কলেজ হাসপাতালে ২০২৪ সালে আব্দুল হালিমের নিম্নমানের লিফট ও রক্ষণাবেক্ষণের অবহেলা কান্ডে একই বছরে দুইজন রোগীর মৃত্যু হয়। লিফটকান্ড ঘটনায় মন্ত্রণালয় থেকে ব্যবস্থা নেওয়ার আদেশ দিলেও অধিদপ্তরের প্রধান প্রকৌশলীর শামীম আখতারের মুরিদ হওয়ায় আব্দুল হালিম এখনও বহাল তবিয়তে।

২০০২ সালে রাজশাহী বিআইটি ছাত্র সংসদ নির্বাচনে আব্দুল হালিম শরীর চর্চা সম্পাদক নির্বাচিত হয়। যখনই যে রাজনৈতিক দল ক্ষমতায় ছিলেন তখনই তার গুনগান গেয়েছেন। ২০২২ সালে ঢাকা গণপূর্ত অধিদপ্তরের ই/এম- ৮ নির্বাহী প্রকৌশলীর দায়িত্ব থাকাকালীন সময়ে স্টাফ অফিসার জোবায়ের আহমেদ স্বাস্থ্যখাতের সব টেন্ডারে আব্দুল হালিমের নির্দেশে ঠিকাদারদের কাছ থেকে প্রতি টেন্ডারে ৫ শতাংশ (প্রাক্কলিত দর) অনুযায়ী কাজ দিয়েছে। পিপিআর অনুযায়ী এলটিএম (লিমিটেড টেন্ডার মেথড) অনুযায়ী দরপত্র হওয়ার কথা থাকলেও তা না করে ওটিএম এর মাধ্যমে টেন্ডার আহবান করে কাজ দিয়ে বিপুল অর্থ লোপাট করেছে। এছাড়াও স্টাফ অফিসার জোবায়ের টেন্ডার আইডি হাইড করে নির্দিষ্ট ঠিকাদার’দের আইডি ও রেট দেখিয়ে ইচ্ছেঅনুযায়ী দাম হাকাতো। ‘সাধারণত পিপিআর অনুযায়ী ইজিপিতে এলটিএম এর বাইরে দরপত্র আহবানের সুযোগ নেই। এলটিএম এর ক্ষেত্রে প্রতি টেন্ডারে ১০ শতাংশ লেসে দর জমা হয়ে, লটারির মাধ্যমে কাজ দেওয়া হয়। এতে সরকারের সিডিউল বেশি বিক্রি হওয়ায় সরকারি কোষাগারে টাকা জমা হওয়ার পাশাপাশি ১০ শতাংশ লেসের কারনে সরকারের অর্থ সাশ্রয় হয়’। হালিম ও জোবায়ের সিন্ডিকেট নিজেদের মনোনীত ব্যক্তিদের প্রাক্কলিত মুল্যে কাজ দেওয়ার কারনে সরকারের ১০ শতাংশ লেসের অর্থ লোকসান হয়। উক্ত ১০ শতাংশ টাকা প্রকৌশলী এবং ঠিকাদার ভাগ করে নেয় তাদের নির্ধারিত কমিশনের বাইরে। সংস্লিষ্ট সুত্র জানায়, স্বাস্থ্য খাতে বেশির ভাগ দরপত্রে মাত্র ১ জন ঠিকাদার অংশ নিয়েছে যা তদন্ত করলে বেরিয়ে আসবে। অভিযোগ রয়েছে, ‘যারা ৫ শতাংশ টাকা দিতে রাজি হয়নি তাদেরকে ১০ শতাংশ লেসে কাজ নিতে বাধ্য করা হয়েছে’।

২০২২-২৩ অর্থবছরের শেষ মুহুর্তে জাতীয় চক্ষু বিজ্ঞান ইনস্টিটিউট ও হাসপাতালের বৈদ্যুতিক কাজ ও তিনটি এয়ারকুলার লাগানোর জন্য এক কোটি ৩৬ লাখ টাকা বরাদ্দ দেওয়া হয়। হাসপাতালের ২য় তলা প্রশাসনিক ভবনে বৈদ্যুতিক ওয়ারিং ও সুইচ পরিবর্তনের জন্য ৩৩ লাখ ৫৪ হাজার টাকা, গার্ডেন লাইট ও সিকিউরিটি লাইটের জন্য ২৮ লাখ ৭০ হাজার টাকা, ইমার্জেন্সি ব্লাকে এসির জন্য ১৫ লাখ ৯৬ হাজার টাকা, রেটিনা ব্লাকের এসির জন্য ২৯ লাখ ৫৫ হাজার ও প্রশাসনিক ব্লকে ভিআরইএফ এসির জন্য ২৯ লাখ টাকা বরাদ্দ দেওয়া হয়। সাধারণত অর্থবছরের শেষমূহুর্তে প্রকল্পের নামে অর্থ-বরাদ্দ দিয়ে লুটপাটের সিদ্ধান্ত নিয়ে হালিম-জোবায়ের সিন্ডিকেট নানা তড়িঘড়ি করেছিলেন। মূলত আব্দুল হালিম অধিদপ্তরের প্রধান প্রকৌশলীর মুরিদ ও আওয়ামী লীগের কুষ্টিয়া ৩ আসনের সংসদ সদস্য মাহবুবউল আলম হানিফের আশীর্বাদপুষ্ট হওয়ায় অর্থবরাদ্দে কোনো বাধাবিপত্তি হতো না।

এছাড়াও ২০২১ সালে আশকোনাস্থ হজ্ব ক্যাম্পের পাওয়ার লাইন, কম্বাাইন্ড সুইচ সকেট পরিবর্তনসহ আনুষঙ্গিক বৈদ্যুতিক কাজের অর্থ বরাদ্দ করানো হলেও নিজের পছন্দের প্রতিষ্ঠানকে কাজ দেওয়ার অভিযোগ ছিলো। কারিগরি অনুমোদন পেতে নিজ উদ্যোগেই টেন্ডার নেওয়ার প্রস্তাব দেন গণপূর্ত ই/এম বিভাগ-৮ (মিরপুর) এর নির্বাহী প্রকৌশলী আব্দুল হালিম। গণপূর্ত ই/এম উপবিভাগ-১৬ (মিরপুর) একজন উপ- সহকারী প্রকৌশলীর কাছ থেকে প্রাক্কলন পেতে সহযোগিতাও করেন তিনি। উক্ত প্রাক্কলনের কারিগরি অনুমোদন পেতে আর্থিক সুবিধা নিয়ে স্বাক্ষর করেন আব্দুল হালিম। তখন ২ লাখ ২৮ হাজার ১৪৪ টাকার মুল্যের একটি প্রাক্কলনের কারিগরি চূড়ান্ত অনুমোদন পেতে আটকে যায় ই/এম-৩, তত্ত্বাবধায়ক প্রকৌশলীর টেবিলে। স্মারক নং- ই/এম-৮ ৭০/২৩০৩ ২০২১ সালের ২৫ মার্চে প্রাক্কলনটিতে ভুয়া স্বাক্ষর দিয়ে দায়িত্ব সেরেছেন নির্বাহী প্রকৌশলী মো. আব্দুল হালিম। ই/এম উপ-বিভাগ-১৬ (মিরপুর) উপ-প্রকৌশলী মো. রবিউল ইসলামের নামে প্রাক্কলনটির কাজ দেখানো হয়।

প্রাক্কলন প্রতিবেদনটিতে বলা হয়, ‘প্রাক্কলনের আইটেম সমূহের দর গণপূর্ত প্রধান প্রকৌশলীর অনুমোদিত সিডিউল ২০১৮ থেকে নেওয়া হয়েছে। যাতে প্রাক্কলিত ব্যয় দাঁড়িয়েছে ২,২৮,১৪৪ টাকা। কাজটির ব্যয়ভার ২০২০-২০২১ অর্থ বছরের কোড নং-৩২৫৮১০৭ অনাবাসিক ভবন খাতের বার্ষিক ক্রয় পরিকল্পনার (এপিপি)ক্রমিক নং-৬৭ হইতে নির্বাহ করা হইবে’।

তবে প্রাক্কলনটি প্রেরণের পর অন্যান্য প্রকৌশলী কারিগরি অনুমোদনে স্বাক্ষর করে দিলেও যথা সময়ে স্বাক্ষর করেননি নির্বাহী প্রকৌশলী আবদুল হালিম। তিনি এ প্রাক্কলন আটকে রেখে ভুক্তভোগী আসিফকে মাসের পর মাস ঘুরিয়েছেন, পরবর্তীতে সাক্ষরের বিনিময়ে মোটা অংকের টাকা সুবিধা নিয়েছেন।

গাজীপুর তাজউদ্দিন হাসপাতালের লিফটটি যেই ব্র্যান্ডের তার মেরামত এবং অন্যান্য কাজ নিয়ম অনুযায়ী সেই ব্র্যান্ডকে দেওয়ার কথা থাকলেও অতিরিক্ত টাকার লোভে জনাব আব্দুল হালিম কাজটি দিয়েছেন সম্পূর্ণ ভিন্ন একটি প্রতিষ্ঠানকে যাদের এই ধরনের কাজের কোন পূর্ব অভিজ্ঞতাই নাই। যার ফলে লিফটে প্রোপার মেরামত বা মেইনটেনেন্স হয়নি। ফলশ্রুতিতে সঠিক সময়ে লিফট সঠিক তলায় না আসায় এক ব্যক্তি মৃত্যুবরণ করে। তৎক্ষণাৎ শুরু হয় জনাব আব্দুল হালিমের ম্যানেজমেন্ট এর প্রক্রিয়া, প্রথমে তিনি মৃতের পরিবারকে ম্যানেজ করেন তারপর তিনি তার ঊর্ধ্বতন ও কর্তৃপক্ষকে ম্যানেজ করতে টাকা খরচ করেন। তদন্তে স্বাস্থ্য অধিদপ্তর জেলা প্রশাসনের সহায়তায় তিন সদস্যের প্রতিনিধিদল গঠন করে।তবে লিফটে আটকে পড়ে মারা যাওয়া মমতাজ বেগমের ছেলে আবদুল মান্নান চিঠির প্রসঙ্গে বলেন, ‘ঘটনা ঘটেছে সকাল সাড়ে ৯টায়। চিঠিতে বলা হয়েছে সোয়া ১১টায়। প্রকৃত ঘটনা আড়াল এবং দায়ীদের রক্ষা করতেই স্বাস্থ্য অধিদপ্তরে চিঠি পাঠানো হয়েছে’।

গণপূর্তের একজন কর্মকর্তা নাম না প্রকাশ করার শর্তে সারাক্ষণ বার্তাকে জানান, ‘হাসপাতালে ছয়টি লিফট রয়েছে। ২৭ প্যাসেঞ্জারের প্রতিটি লিফট কেনায় খরচ হয়েছে ৫৫ থেকে ৬০ লাখ টাকা। দরপত্র অনুযায়ী ইতালির বিখ্যাত মভি ব্র্যান্ডের লিফট সরবরাহ করার কথা। কিন্তু ইলেকট্রিক মোটর ছাড়া কেবিন ও যন্ত্রাংশ দেওয়া হয়েছে চীনের’।

এছাড়াও নিম্নমানের যন্ত্রাংশ ব্যবহার করায় লোড বেশি হলেই আটকা পড়ে লিফট। প্রতি মাসে রক্ষণাবেক্ষণের কথা থাকলেও তা শুধু কাগজে-কলমেই দেখানো হয়। তিন শিফটে ৯ জন লিফটম্যান কাজ করে দেখানো হলেও দুই-তিনজনের বেশি খুঁজে পাওয়া যায় না। তৎকালীন সময়ে হাসপাতালের পরিচালক ডা. আমিনুল ইসলাম সারাক্ষণ বার্তাকে জানান, লিফট সমস্যার কথা প্রায়ই কর্মচারীরা তাঁকে জানান। তিনি গণপূর্ত বিভাগকে জানিয়ে দেন। পরিদর্শনে গিয়ে প্রায়ই লিফটম্যান কম পান। লিফটের ভেতরে থেকে দায়িত্ব পালনে নিষেধের বিষয়টিকে তিনি ‘ডাহা মিথ্যা’ বলে উল্লেখ করেন। ‘ছয় লিফটের চারটিই নষ্ট’ লিফটকান্ড বিষয়ে পরবর্তী ধারাবাহিক অনুসন্ধানী প্রতিবেদনে সকল তথ্য তুলে ধরা হবে।

 

তাই যত সময়ে লিফটের কোন মেরামত না হওয়ায় কিছুদিন পরে ওই লিফটে দুর্ঘটনার পুনরাবৃত্তি ঘটে এবং আরো একজন ব্যক্তি মারা যায়। এ বিষয়ে ডিসি অফিসের তদন্ত কমিটি রিপোর্ট দেন যে উক্ত বিভাগে নির্বাহী প্রকৌশলীর বিরুদ্ধে আইনানক ব্যবস্থা নেওয়া যেতে পারে, এমনকি চাকরি থেকে বরখাস্তের কথাও বলা হয় উক্ত পত্রে। তারপরেও তিনি বহাল তবিয়তের দায়িত্ব পালন করছেন।

সারাক্ষণ বার্তার অনুসন্ধানে উঠে আসে, গণপূর্ত ই.এম বিভাগ ১০ এর আব্দুল হালিমের নির্দিষ্ট ঠিকাদার ‘জামিমা এন্টারপ্রাইজ’ এবং ‘জাফর ব্রাদার্স’ । তাদের নামে ব্যবসা করে মোঃ আব্দুল হালিম নিজেই কাজ করেন, যা ওপেন সিক্রেট।

অভিযোগ প্রসঙ্গে জানতে চাইলে মোঃ আব্দুল হালিম’কে একাধিকবার মুঠোফোনে ফোন করা হলেও কল রিসিভ করেনি।

পরবর্তী ধারাবাহিক প্রতিবেদনে আব্দুল হালিমের সম্পদের বিবরন ও আমলনামা তুলে ধরা হবে।

Tag :
About Author Information

GOURANGA BOSE

জনপ্রিয় সংবাদ

নেপথ্যে ১০ কোটি টাকার নিয়োগ বাণিজ্য: প্রাণিসম্পদ অধিদপ্তরে হাইকোর্টের আপীল বিভাগের নির্দেশনা অমান্য করে ৫৪ জন কর্মচারি নিয়োগ, আরো প্রায় ৬০০জনের নিয়োগ চুড়ান্ত! 

“হাসপাতালে লিফটকান্ড” গণপূর্ত নির্বাহী প্রকৌশলী হালিমের তদারকিতে সীমাহীন দুর্নীতি!

আপডেট সময় : ০৮:২৬:৩৬ অপরাহ্ন, বুধবার, ১০ সেপ্টেম্বর ২০২৫

গৃহায়ণ ও গণপূর্ত মন্ত্রণালয়ের অধীনে গণপূর্ত অধিদপ্তর বিভিন্ন রাষ্ট্রীয় গুরুত্বপূর্ণ স্থাপনা নির্মাণ ও তার সংস্কার কাজের সাথে সম্পৃক্ত রয়েছে। গুরুত্বপূর্ণ এই মন্ত্রণালয়টির উপর নজরদারী ও ক্ষমতার ভাগ বসাতে দেশের ক্ষমতাশীলরা সর্বদাই তৎপর থাকে। এই মন্ত্রণালয় ঘিরে অবকাঠামো নির্মাণ ও উন্নয়নে প্রতি বছর হাজার হাজার কোটি টাকার কাজ সম্পাদন হয়। আর এ কারণেই এই মন্ত্রণালয়টি অন্যান্য মন্ত্রণালয় থেকে বেশী গুরুত্বপূর্ণ বিশেষ করে ঠিকাদার ও ব্যবসায়ীদের নিকট। গণপূর্ত অধিদপ্তর থেকে সুযোগ সুবিধা গ্রহন করে এর সাথে সম্পৃক্ত ঠিকাদার ও কিছু দুর্নীতি পরায়ণ প্রকৌশলী শত শত কোটি টাকার মালিক বনে গেছে। এই কার্যক্রম অতীতেও ছিলো এবং বর্তমানেও চলমান আছে। একটি শক্তিশালী সিন্ডিকেট প্রত্যক্ষ ও পরোক্ষভাবে সহযোগিতা করার ক্ষেত্রে মন্ত্রণালয় ও অধিদপ্তরের মূল ভুমিকার কর্তারা জড়িত। কর্তাদের পুজি করেই কিছু প্রকৌশলী হয়ে উঠেছে বেপরোয়া। তার মধ্যে অন্যতম ঢাকা গণপূর্ত ই/এম বিভাগ-১০ এর নির্বাহী প্রকৌশলী আব্দুল হালিম। অভিযোগ রয়েছে, কমিশনের বিনিময়ে কাজ প্রদান, উন্নয়ন কাজ না করেই সরকারি বরাদ্দের কোটি কোটি টাকা তুলে নিয়ে ঠিকাদারের সাথে ভাগাভাগি, চাকুরী জীবনে অসততার আশ্রয় নিয়ে অঢেল ধন সম্পদের মালিক এবং গাজীপুরের শহীদ তাজউদ্দীন আহমদ মেডিক্যাল কলেজ হাসপাতালে ২০২৪ সালে আব্দুল হালিমের নিম্নমানের লিফট ও রক্ষণাবেক্ষণের অবহেলা কান্ডে একই বছরে দুইজন রোগীর মৃত্যু হয়। লিফটকান্ড ঘটনায় মন্ত্রণালয় থেকে ব্যবস্থা নেওয়ার আদেশ দিলেও অধিদপ্তরের প্রধান প্রকৌশলীর শামীম আখতারের মুরিদ হওয়ায় আব্দুল হালিম এখনও বহাল তবিয়তে।

২০০২ সালে রাজশাহী বিআইটি ছাত্র সংসদ নির্বাচনে আব্দুল হালিম শরীর চর্চা সম্পাদক নির্বাচিত হয়। যখনই যে রাজনৈতিক দল ক্ষমতায় ছিলেন তখনই তার গুনগান গেয়েছেন। ২০২২ সালে ঢাকা গণপূর্ত অধিদপ্তরের ই/এম- ৮ নির্বাহী প্রকৌশলীর দায়িত্ব থাকাকালীন সময়ে স্টাফ অফিসার জোবায়ের আহমেদ স্বাস্থ্যখাতের সব টেন্ডারে আব্দুল হালিমের নির্দেশে ঠিকাদারদের কাছ থেকে প্রতি টেন্ডারে ৫ শতাংশ (প্রাক্কলিত দর) অনুযায়ী কাজ দিয়েছে। পিপিআর অনুযায়ী এলটিএম (লিমিটেড টেন্ডার মেথড) অনুযায়ী দরপত্র হওয়ার কথা থাকলেও তা না করে ওটিএম এর মাধ্যমে টেন্ডার আহবান করে কাজ দিয়ে বিপুল অর্থ লোপাট করেছে। এছাড়াও স্টাফ অফিসার জোবায়ের টেন্ডার আইডি হাইড করে নির্দিষ্ট ঠিকাদার’দের আইডি ও রেট দেখিয়ে ইচ্ছেঅনুযায়ী দাম হাকাতো। ‘সাধারণত পিপিআর অনুযায়ী ইজিপিতে এলটিএম এর বাইরে দরপত্র আহবানের সুযোগ নেই। এলটিএম এর ক্ষেত্রে প্রতি টেন্ডারে ১০ শতাংশ লেসে দর জমা হয়ে, লটারির মাধ্যমে কাজ দেওয়া হয়। এতে সরকারের সিডিউল বেশি বিক্রি হওয়ায় সরকারি কোষাগারে টাকা জমা হওয়ার পাশাপাশি ১০ শতাংশ লেসের কারনে সরকারের অর্থ সাশ্রয় হয়’। হালিম ও জোবায়ের সিন্ডিকেট নিজেদের মনোনীত ব্যক্তিদের প্রাক্কলিত মুল্যে কাজ দেওয়ার কারনে সরকারের ১০ শতাংশ লেসের অর্থ লোকসান হয়। উক্ত ১০ শতাংশ টাকা প্রকৌশলী এবং ঠিকাদার ভাগ করে নেয় তাদের নির্ধারিত কমিশনের বাইরে। সংস্লিষ্ট সুত্র জানায়, স্বাস্থ্য খাতে বেশির ভাগ দরপত্রে মাত্র ১ জন ঠিকাদার অংশ নিয়েছে যা তদন্ত করলে বেরিয়ে আসবে। অভিযোগ রয়েছে, ‘যারা ৫ শতাংশ টাকা দিতে রাজি হয়নি তাদেরকে ১০ শতাংশ লেসে কাজ নিতে বাধ্য করা হয়েছে’।

২০২২-২৩ অর্থবছরের শেষ মুহুর্তে জাতীয় চক্ষু বিজ্ঞান ইনস্টিটিউট ও হাসপাতালের বৈদ্যুতিক কাজ ও তিনটি এয়ারকুলার লাগানোর জন্য এক কোটি ৩৬ লাখ টাকা বরাদ্দ দেওয়া হয়। হাসপাতালের ২য় তলা প্রশাসনিক ভবনে বৈদ্যুতিক ওয়ারিং ও সুইচ পরিবর্তনের জন্য ৩৩ লাখ ৫৪ হাজার টাকা, গার্ডেন লাইট ও সিকিউরিটি লাইটের জন্য ২৮ লাখ ৭০ হাজার টাকা, ইমার্জেন্সি ব্লাকে এসির জন্য ১৫ লাখ ৯৬ হাজার টাকা, রেটিনা ব্লাকের এসির জন্য ২৯ লাখ ৫৫ হাজার ও প্রশাসনিক ব্লকে ভিআরইএফ এসির জন্য ২৯ লাখ টাকা বরাদ্দ দেওয়া হয়। সাধারণত অর্থবছরের শেষমূহুর্তে প্রকল্পের নামে অর্থ-বরাদ্দ দিয়ে লুটপাটের সিদ্ধান্ত নিয়ে হালিম-জোবায়ের সিন্ডিকেট নানা তড়িঘড়ি করেছিলেন। মূলত আব্দুল হালিম অধিদপ্তরের প্রধান প্রকৌশলীর মুরিদ ও আওয়ামী লীগের কুষ্টিয়া ৩ আসনের সংসদ সদস্য মাহবুবউল আলম হানিফের আশীর্বাদপুষ্ট হওয়ায় অর্থবরাদ্দে কোনো বাধাবিপত্তি হতো না।

এছাড়াও ২০২১ সালে আশকোনাস্থ হজ্ব ক্যাম্পের পাওয়ার লাইন, কম্বাাইন্ড সুইচ সকেট পরিবর্তনসহ আনুষঙ্গিক বৈদ্যুতিক কাজের অর্থ বরাদ্দ করানো হলেও নিজের পছন্দের প্রতিষ্ঠানকে কাজ দেওয়ার অভিযোগ ছিলো। কারিগরি অনুমোদন পেতে নিজ উদ্যোগেই টেন্ডার নেওয়ার প্রস্তাব দেন গণপূর্ত ই/এম বিভাগ-৮ (মিরপুর) এর নির্বাহী প্রকৌশলী আব্দুল হালিম। গণপূর্ত ই/এম উপবিভাগ-১৬ (মিরপুর) একজন উপ- সহকারী প্রকৌশলীর কাছ থেকে প্রাক্কলন পেতে সহযোগিতাও করেন তিনি। উক্ত প্রাক্কলনের কারিগরি অনুমোদন পেতে আর্থিক সুবিধা নিয়ে স্বাক্ষর করেন আব্দুল হালিম। তখন ২ লাখ ২৮ হাজার ১৪৪ টাকার মুল্যের একটি প্রাক্কলনের কারিগরি চূড়ান্ত অনুমোদন পেতে আটকে যায় ই/এম-৩, তত্ত্বাবধায়ক প্রকৌশলীর টেবিলে। স্মারক নং- ই/এম-৮ ৭০/২৩০৩ ২০২১ সালের ২৫ মার্চে প্রাক্কলনটিতে ভুয়া স্বাক্ষর দিয়ে দায়িত্ব সেরেছেন নির্বাহী প্রকৌশলী মো. আব্দুল হালিম। ই/এম উপ-বিভাগ-১৬ (মিরপুর) উপ-প্রকৌশলী মো. রবিউল ইসলামের নামে প্রাক্কলনটির কাজ দেখানো হয়।

প্রাক্কলন প্রতিবেদনটিতে বলা হয়, ‘প্রাক্কলনের আইটেম সমূহের দর গণপূর্ত প্রধান প্রকৌশলীর অনুমোদিত সিডিউল ২০১৮ থেকে নেওয়া হয়েছে। যাতে প্রাক্কলিত ব্যয় দাঁড়িয়েছে ২,২৮,১৪৪ টাকা। কাজটির ব্যয়ভার ২০২০-২০২১ অর্থ বছরের কোড নং-৩২৫৮১০৭ অনাবাসিক ভবন খাতের বার্ষিক ক্রয় পরিকল্পনার (এপিপি)ক্রমিক নং-৬৭ হইতে নির্বাহ করা হইবে’।

তবে প্রাক্কলনটি প্রেরণের পর অন্যান্য প্রকৌশলী কারিগরি অনুমোদনে স্বাক্ষর করে দিলেও যথা সময়ে স্বাক্ষর করেননি নির্বাহী প্রকৌশলী আবদুল হালিম। তিনি এ প্রাক্কলন আটকে রেখে ভুক্তভোগী আসিফকে মাসের পর মাস ঘুরিয়েছেন, পরবর্তীতে সাক্ষরের বিনিময়ে মোটা অংকের টাকা সুবিধা নিয়েছেন।

গাজীপুর তাজউদ্দিন হাসপাতালের লিফটটি যেই ব্র্যান্ডের তার মেরামত এবং অন্যান্য কাজ নিয়ম অনুযায়ী সেই ব্র্যান্ডকে দেওয়ার কথা থাকলেও অতিরিক্ত টাকার লোভে জনাব আব্দুল হালিম কাজটি দিয়েছেন সম্পূর্ণ ভিন্ন একটি প্রতিষ্ঠানকে যাদের এই ধরনের কাজের কোন পূর্ব অভিজ্ঞতাই নাই। যার ফলে লিফটে প্রোপার মেরামত বা মেইনটেনেন্স হয়নি। ফলশ্রুতিতে সঠিক সময়ে লিফট সঠিক তলায় না আসায় এক ব্যক্তি মৃত্যুবরণ করে। তৎক্ষণাৎ শুরু হয় জনাব আব্দুল হালিমের ম্যানেজমেন্ট এর প্রক্রিয়া, প্রথমে তিনি মৃতের পরিবারকে ম্যানেজ করেন তারপর তিনি তার ঊর্ধ্বতন ও কর্তৃপক্ষকে ম্যানেজ করতে টাকা খরচ করেন। তদন্তে স্বাস্থ্য অধিদপ্তর জেলা প্রশাসনের সহায়তায় তিন সদস্যের প্রতিনিধিদল গঠন করে।তবে লিফটে আটকে পড়ে মারা যাওয়া মমতাজ বেগমের ছেলে আবদুল মান্নান চিঠির প্রসঙ্গে বলেন, ‘ঘটনা ঘটেছে সকাল সাড়ে ৯টায়। চিঠিতে বলা হয়েছে সোয়া ১১টায়। প্রকৃত ঘটনা আড়াল এবং দায়ীদের রক্ষা করতেই স্বাস্থ্য অধিদপ্তরে চিঠি পাঠানো হয়েছে’।

গণপূর্তের একজন কর্মকর্তা নাম না প্রকাশ করার শর্তে সারাক্ষণ বার্তাকে জানান, ‘হাসপাতালে ছয়টি লিফট রয়েছে। ২৭ প্যাসেঞ্জারের প্রতিটি লিফট কেনায় খরচ হয়েছে ৫৫ থেকে ৬০ লাখ টাকা। দরপত্র অনুযায়ী ইতালির বিখ্যাত মভি ব্র্যান্ডের লিফট সরবরাহ করার কথা। কিন্তু ইলেকট্রিক মোটর ছাড়া কেবিন ও যন্ত্রাংশ দেওয়া হয়েছে চীনের’।

এছাড়াও নিম্নমানের যন্ত্রাংশ ব্যবহার করায় লোড বেশি হলেই আটকা পড়ে লিফট। প্রতি মাসে রক্ষণাবেক্ষণের কথা থাকলেও তা শুধু কাগজে-কলমেই দেখানো হয়। তিন শিফটে ৯ জন লিফটম্যান কাজ করে দেখানো হলেও দুই-তিনজনের বেশি খুঁজে পাওয়া যায় না। তৎকালীন সময়ে হাসপাতালের পরিচালক ডা. আমিনুল ইসলাম সারাক্ষণ বার্তাকে জানান, লিফট সমস্যার কথা প্রায়ই কর্মচারীরা তাঁকে জানান। তিনি গণপূর্ত বিভাগকে জানিয়ে দেন। পরিদর্শনে গিয়ে প্রায়ই লিফটম্যান কম পান। লিফটের ভেতরে থেকে দায়িত্ব পালনে নিষেধের বিষয়টিকে তিনি ‘ডাহা মিথ্যা’ বলে উল্লেখ করেন। ‘ছয় লিফটের চারটিই নষ্ট’ লিফটকান্ড বিষয়ে পরবর্তী ধারাবাহিক অনুসন্ধানী প্রতিবেদনে সকল তথ্য তুলে ধরা হবে।

 

তাই যত সময়ে লিফটের কোন মেরামত না হওয়ায় কিছুদিন পরে ওই লিফটে দুর্ঘটনার পুনরাবৃত্তি ঘটে এবং আরো একজন ব্যক্তি মারা যায়। এ বিষয়ে ডিসি অফিসের তদন্ত কমিটি রিপোর্ট দেন যে উক্ত বিভাগে নির্বাহী প্রকৌশলীর বিরুদ্ধে আইনানক ব্যবস্থা নেওয়া যেতে পারে, এমনকি চাকরি থেকে বরখাস্তের কথাও বলা হয় উক্ত পত্রে। তারপরেও তিনি বহাল তবিয়তের দায়িত্ব পালন করছেন।

সারাক্ষণ বার্তার অনুসন্ধানে উঠে আসে, গণপূর্ত ই.এম বিভাগ ১০ এর আব্দুল হালিমের নির্দিষ্ট ঠিকাদার ‘জামিমা এন্টারপ্রাইজ’ এবং ‘জাফর ব্রাদার্স’ । তাদের নামে ব্যবসা করে মোঃ আব্দুল হালিম নিজেই কাজ করেন, যা ওপেন সিক্রেট।

অভিযোগ প্রসঙ্গে জানতে চাইলে মোঃ আব্দুল হালিম’কে একাধিকবার মুঠোফোনে ফোন করা হলেও কল রিসিভ করেনি।

পরবর্তী ধারাবাহিক প্রতিবেদনে আব্দুল হালিমের সম্পদের বিবরন ও আমলনামা তুলে ধরা হবে।