চট্টগ্রাম শহরের পাঁচলাইশে অবস্থিত জুলাই স্মৃতি উদ্যান (সাবেক জাতিসংঘ পার্ক)-এর সৌন্দর্যবর্ধন কাজে ব্যাপক অনিয়ম ও মাত্রাতিরিক্ত অর্থ ব্যয়ের অভিযোগ উঠেছে। ১১ কোটি ৭০ লাখ টাকা ব্যয়ে সম্পন্ন হওয়া এই প্রকল্পে নিম্নমানের সামগ্রী ব্যবহার করা হয়েছে, যার ফলে উদ্বোধনের এক বছরের মধ্যেই নানা ত্রুটি দেখা দিয়েছে।
গণপূর্ত মন্ত্রণালয় সূত্রে জানা যায়, তৎকালীন জাতিসংঘ পার্কের সৌন্দর্যবর্ধনের জন্য ২০২২ সালে মন্ত্রণালয় ১১ কোটি ৭০ লাখ টাকা বরাদ্দ দেয়। এই বরাদ্দের মধ্যে ৩৫৩.৫৫ মিটার বাউন্ডারি ওয়াল নির্মাণে ব্যয় দেখানো হয়েছে ২ কোটি ৪৪ লাখ ৪৫ হাজার টাকা, অর্থাৎ প্রতি মিটারে খরচ হয়েছে ৬৯ হাজার ১৪২ টাকা। সংশ্লিষ্ট কাজে অভিজ্ঞ প্রকৌশলীদের মতে, এ ধরনের বাউন্ডারি ওয়াল নির্মাণে প্রতি মিটারে সর্বোচ্চ ব্যয় (ঠিকাদারের লাভ ও ভ্যাট, ট্যাক্সসহ) ১২ থেকে ১৫ হাজার টাকা হতে পারে। ৪৪টি আরসিসি বসার টুল বানাতে ৩৫ লাখ ৯২ হাজার টাকা খরচ দেখানো হয়েছে, যেখানে প্রতিটির খরচ পড়েছে ৮১ হাজার ৬০০ টাকা; অথচ এ ধরনের একটি টুলের সর্বোচ্চ খরচ ২০ থেকে ২৫ হাজার টাকা হতে পারে।
এছাড়াও, ১টি ডিপ টিউবওয়েল বসাতে ১৬ লাখ ৮৭ হাজার টাকা ব্যয় দেখানো হয়েছে, যার সর্বোচ্চ ব্যয় ৮ থেকে ৯ লাখ টাকা হওয়ার কথা। মাটি পরীক্ষার জন্য ২ লাখ ১২ হাজার টাকা এবং মান নিয়ন্ত্রণ, উপাদান নমুনা সংগ্রহ ও পরীক্ষাকরণ বাবদ ৩ লাখ টাকা ব্যয় ধরা হয়েছে। ১টি ফাউন্টেন লাইটের দাম ধরা হয়েছে ২ লাখ টাকা, যেখানে ৪০ থেকে ৫০ হাজার টাকায় ভালো মানের ফাউন্টেন লাইট পাওয়া যায়। ৭০ হাজার গ্যালনের একটি জলাধার ও ঝরনা নির্মাণে ৭৫ লাখ টাকা এবং ২টি মেটাল পারগোলারের জন্য ১৫ লাখ ৪৮ হাজার টাকা ব্যয় ধরা হয়েছে। শিশুদের খেলাধুলার জন্য ৫টি সরঞ্জাম কিনতে ১৯ লাখ ৩০ হাজার টাকা এবং শরীর চর্চার জন্য ২টি হরিজন্টাল বার কিনতে ৩ লাখ ৭৫ হাজার টাকা ব্যয় করা হয়েছে। পার্কের ভেতরে ছোট ছোট গাছের চারা লাগানোর পেছনে প্রায় ৫০ লাখ টাকা ব্যয় দেখানো হয়েছে। একটি স্ট্রিট লাইট খাম্বার ওপর লাগানো বজ্র নিরোধক ব্যবস্থার জন্য ১৭ লাখ ৬৯ হাজার টাকা এবং একটি ৩০ কেভিএ ডিজেল জেনারেটরের জন্য ২০ লাখ টাকা ব্যয় করা হয়েছে।
২০২৪ সালে কাজ শেষ হওয়া এই পার্কটিতে সরেজমিনে গিয়ে দেখা যায়, প্রতি মিটার ৬৯ হাজার ১৪২ টাকা ব্যয়ে নির্মিত বাউন্ডারি ওয়ালে বড় ধরনের ফাটল দেখা গেছে, যা পার্কের চারদিকেই চোখে পড়েছে। ভেতরের অধিক দামের টাইলসের রং নষ্ট হয়ে গেছে এবং টাইলসের মাঝখানে থাকা সিমেন্ট খুলে ফাঁকা হয়ে গেছে। ওয়াকওয়েসহ বসার জায়গায় টুলের নিচে পানি জমে আছে, যদিও পানি নিষ্কাশনের জন্য মোটর ব্যবহার করা হলেও তা অকার্যকর। ৪৪টি আরসিসি টুল বানানোর কথা থাকলেও সংখ্যায় অনেক কম পাওয়া গেছে। ঝরনায় লাগানো টাইলস অনেক স্থানে সাদা হয়ে গেছে এবং পাশের সিমেন্টের ব্লকগুলোতে ফুসকুড়ি দেখা দিয়েছে, অনেক স্থানে ভাঙাও।
সংশ্লিষ্ট কাজে অভিজ্ঞ প্রকৌশলীরা জানিয়েছেন, এই পার্কের সৌন্দর্যবর্ধন কাজে যে ব্যয় দেখানো হয়েছে, তা স্বাভাবিকের তুলনায় অনেক বেশি এবং নির্মাণ সামগ্রী নিম্নমানের ব্যবহার করা হয়েছে। ময়লা ও লবণাক্ত বালি ব্যবহারের ফলে ফুসকুড়ি দেখা দিয়েছে এবং প্রয়োজনের তুলনায় সিমেন্ট কম দেওয়ায় সিমেন্ট উঠে যাচ্ছে। নিম্নমানের সামগ্রীর ফলেই দেয়াল ফেটে গেছে। অভিযোগ উঠেছে, সংশ্লিষ্ট কর্মকর্তা ও ঠিকাদার সিন্ডিকেট মিলে এই প্রকল্প থেকে সরকারের বড় অঙ্কের টাকা আত্মসাৎ করেছে।
এ বিষয়ে জানতে কাজের দায়িত্বপ্রাপ্ত কর্মকর্তা, চট্টগ্রামের গণপূর্ত সার্কেল ১-এর তৎকালীন নির্বাহী প্রকৌশলী রাজিব গুহের মোবাইলে একাধিকবার কল দিয়েও তাকে পাওয়া যায়নি।
এ বিষয়ে চট্টগ্রামের গণপূর্ত সার্কেল ১-এর নির্বাহী প্রকৌশলী কামরুল ইসলাম বলেন, “বাউন্ডারি ওয়ালের ফাটলগুলো আমি দেখেছি, কিছু রড বাঁকা হয়ে গেছে, ফলে এমন ফাটল সৃষ্টি হয়েছে। অন্যান্য কিছু ত্রুটি আছে, আমরা সমাধান করছি।”উল্লেখ নির্বাহী প্রকৌশলী কামরুল ইসলাম এর আগে মাদারীপুরে কর্মরত থাকাকালীন সমন্বিত ভবন নির্মাণের দুর্নীতির দায় নিয়ে চট্টগ্রামে বদলি হয়েছেন। বিষয়টি দুদকে তদন্তাধীন রয়েছে।জানা যায় বিগত সরকারের চীফ হুইপ নূরে আলম লিটন চৌধুরীর ঘনিষ্ঠজন ছিলেন। সেই হিসেবে দুর্নীতির মাস্টার মাইন্ড হিসেবে প্রকৌশলী কামরুল ইসলাম সমধিক খ্যাতির শীর্ষে রয়েছেন। শরিয়তপুর জেলার সর্বত্র দুর্নীতি বরপুত্র হিসেবে তাকে চেনে। এতো কিছুর পরেও বহাল তবিয়তে আছেন দুর্নীতির দায়ে অভিযুক্ত প্রকৌশলী কামরুল ইসলাম। হয়তো প্রশাসনের আরো বড় কোন কর্মকর্তার নেক নজরে আরাম- আয়েশে আছেন তিনি।
উল্লেখ্য, গৃহায়ন ও গণপূর্ত মন্ত্রণালয়ের উদ্যোগে গণপূর্ত অধিদপ্তর কর্তৃক বাস্তবায়নের জন্য প্রস্তাবিত “চট্টগ্রাম জেলার পাঁচলাইশ আবাসিক এলাকায় আধুনিক সুযোগ-সুবিধা সম্পন্ন জাতিসংঘ সবুজ উদ্যান (বর্তমানে জুলাই স্মৃতি উদ্যান) উন্নয়ন”-শীর্ষক বিনিয়োগ প্রকল্পটি ২০২২ সালের ৪ জুলাই পরিকল্পনা মন্ত্রী অনুমোদন দেন। এর মোট ব্যয় ১১ কোটি ৭০ লাখ ১২ হাজার টাকা এবং বাস্তবায়নকাল জুলাই ২০২২ থেকে জুন ২০২৪।